Sunday, 29 October 2017

রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় দুর্গোৎসব...

বাঙালিদের সব থেকে অন্যতম বড় উৎসব দুর্গোৎসব। কিন্তু কেন? দেখা যায়, দুর্গোৎসব বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বিশেষ করে হিন্দু বাঙালিদের কাছে সবচেয়ে বড় উৎসব। দেবী দুর্গার পুত্র-কন্যাদের মধ্যে একেকজন পৃথকভাবে ভারতের নানাদিকে পূজিত, যেমন মহারাষ্ট্রে গণেশের পূজার গুরুত্ব অনেক বেশি। লক্ষ্মী, সরস্বতীরও ভক্তসংখ্যা কম নয়। কিন্তু সমস্ত পুত্র-কন্যা সমেত, সিংহ বাহিনী, অসুরদলনী দুর্গা এক চালচিত্রে গ্রথিতরূপে অন্যত্র কোথাও পুজিত হন না। এখানেই বাঙালির দুর্গোৎসবের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট। অনেকের মুখে শোনা যায়, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে বর্তমান আকারে মৃন্ময়ী মুর্ত্তিতে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব প্রচলিত হয়েছে। অর্থাৎ তার আগে বর্তমান আকারে মৃন্ময়ীমূর্তিতে দুর্গাপূজা হতো না; ইতিহাসের বিচারে তা মোটেই সত্য নয়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজ রাজত্বের প্রথমভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর স্মার্ত্তপ্রবর রঘুনন্দন ন্যূনতম চারশত বছর আগে শ্রীমন্মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সময় প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। রঘুনন্দনের দুর্গোৎসবতত্ত্ব, দুর্গাপূজাতত্ত্ব ও দুর্গাপ্রয়োগতত্ত্ব পাঠ করলেই স্পষ্টই বোধ হয়, তৎকালে বর্তমান আকারে মৃন্ময়ীমূর্তিতেই শারদীয়া দুর্গাপূজা হত এবং তাহার ব্যবস্থা ও পদ্ধতির জন্যে এই তিনখানা গ্রন্থ লিখে গিয়েছিলেন। ঈশ - সত্তার মাতৃরূপের ভজনা ও পূজা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রচলিত। সর্বজনীনতার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে দুর্গোৎসবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল ও হিতকামনায় এমন বৃহত্তর আয়োজন সত্যিই অনন্য। যারা নিরাকার সাধনায় বিশ্বাস করেন, তাদেরও এই উৎসব নানাভাবে অপ্রত্যক্ষে আহ্বান করে। অবশ্য শ্রদ্ধার সঙ্গে, আত্যন্তিক প্রয়োজনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরকে গতানুগতিক অনুসন্ধান করতে চাননি। তাঁর সমগ্র ধ্যান ধারণা ও কর্মসাধনায় অনন্তের চৈতন্যই সমধিক গুরুত্ব পেয়েছে। গৃহ ও গৃহকাজের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছেন। আজ গোটা দুনিয়ার গবেষকরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা,গান, প্রবন্ধ, ছবিআঁকা নিয়ে গবেষণা করছেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। তাহলে বাঙালির চিরন্তন উৎসব দুর্গাপূজা নিয়ে তাঁর ভাবনা কী ছিল? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুর্গাপূজা ভাবনাটা আসলে বিশেষ জটিল। জটিল কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। এই লেখার ভিতরে কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথের যে উক্তিগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো মোটেই দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু বলা যায় সবিশেষ জটিল। কবিগুরু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, উৎসবের দিন একলার গৃহ সকলের গৃহ হয়। ১৯০৩ সালের ২২শে অক্টোবর বোলপুর থেকে কাদম্বিনী দেবীকে লেখা একটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, “সাকার নিরাকার একটা কথার কথামাত্র। ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর কেন আমরা প্রত্যেকেই সাকারও বটে নিরাকারও বটে। আমি এ সকল মতামত লইয়া বাদ-বিবাদ করিতে চাই না। তাহাকে রূপে এবং ভাবে, আকারে এবং নিরাকারে, কর্মে এবং প্রেমে সকল রকমেই ভজনা করিতে হইবে। আকার তো আমাদের রচনা নহে, আকার তো তাঁহার-ই।” এরও দুবছর পরে ১৯১২ সালের ১৮ মার্চ আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কাদম্বিনী দেবীকে লেখেন, “প্রতিমা সম্বন্ধে আমার মনে কোনো বিরুদ্ধতা নেই। অর্থাৎ যদি কোনো বিশেষ মূর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই কোনো মুস্কিল থাকে না। তাকে বিশেষ কোনো একটি চিহ্নদ্বারা নিজের মনে স্থির করে নিয়ে রাখলে কোনো দোষ আছে একথা আমি মনে করিনে। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনো মূঢ়তাকে পোষণ করলেই তার বিপদ আছে।” বস্তুতপক্ষে ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উদার মনোভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজেই কাদম্বিনী দেবীকে একবার লিখেছিলেন, “নানা ব্রাহ্ম সমাজ আমাকে ঠিক ব্রাহ্ম বলে গ্রহণ করেননি এবং আমাকে তাঁরা বিশেষ অনুকূল দৃষ্টিতে কোনোদিন দেখেননি। (চিঠিপত্র, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৮)। ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই ধারণা বহুদিন আগেই গড়ে উঠেছে। তাই প্রচলিত পূজার্চনাবিধির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রবীন্দ্রনাথ বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। আমাদের দেশের পূজার্চনাবিধি সম্পর্কে এবং এর মূল্যবোধ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা থাকলেও দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার করে এই পূজার্চনাবিধিকে যাতে কোনো কিছু কলুষিত না করে সে সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। প্রসঙ্গত, এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এককালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল এবং তা হয় নীলমণি ঠাকুরের আমলে থেকেই। ১৭৮৪ সালের জুন মাস থেকে নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকোয় গোলপাতার ঘর করে বসবাস শুরু করেন। তখন অবশ্য জোড়াসাঁকোর নাম ছিল মেছুয়াবাজার। নীলমণি ঠাকুরের কন্যা কমলমণি গল্প করতেন যে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির “প্রথম দুর্গাপূজা খোলার ঘরে হয়”। বস্তুত দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোর সমারোহ কিন্তু শুরু হয়। তাঁর আমলে ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, সরস্বতীপুজো অনুষ্ঠিত হতো। তবে যেহেতু দ্বারকানাথ নিজে ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন, তাই পুজোয় জীববলি হত না। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “আমাদের বৈষ্ণব পরিবারে কী ভাগ্যি পশুবলির বীভৎস কাণ্ড ছিল না সেই রক্ষা, - পশুর বদল কুমড়ো বলি হয় এই শুনতুম।” এ প্রসঙ্গে তখনকার কালের সংবাদপত্রে এই খবরটি প্রকাশিত হয় যে, “শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহিত রামমোহন রায়ের আত্মীয়তা আছে কিন্তু রায়জী তাঁহার নিত্যকর্ম কিছুই রহিত করাইতে পারিয়াছেন তাহা কখনই পারিবেন না। ওই বাবুর বাটিতে দুর্গোৎসব, শ্যামপূজা, জগদ্ধত্রী পূজা ইত্যাদি তাবৎ কর্ম হইয়া থাকে।” দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর এক ভাষণে উল্লেখ করেছেন যে, “প্রথম বয়সে উপনয়নের পর প্রতিনিয়ত যখন গৃহেতে শালগ্রাম শিলার অর্চনা দেখিতাম, প্রতি বৎসর যখন দুর্গাপূজার উৎসবে উৎসাহিত হইতাম তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রাম শিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।”
২.
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপুজোর সময় ইচ্ছে করেই প্রবাসে কাটাতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “পুজোর সময় কোনও মতেই পিতা বাড়ি থাকিতেন না এজন্যই পুজোর উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না।”
“যষ্ঠীর দিন সবাইকে জিনিসপত্র ‘বিলি’ করে দেওয়া হত। শুধু ছেলেমেয়েরাই নয়, আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভৃত্য এবং ঝিয়েরাও নতুন জামাকাপড় পেতেন। এর পরে আসত পার্বণীর পালা। ...দ্বারকানাথ অত্যন্ত দরাজ ছিলেন এবং প্রচুর খরচ করতেন। এ সময়েই মোয়া, ক্ষীর প্রভৃতি মিশিয়ে একটি বৃহদাকার মেঠাই পুজোর সময় তৈরি করা হত এবং ফুটবলসদৃশ এই বিশাল মেঠাইয়ের স্মৃতি অনেকের মন থেকেই মিলিয়ে যায়নি।”
রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, “দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতুম, তাদের ধূপধুনা বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম, এত বাহ্য আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার আধ্যাত্মিক জিনিস।”
বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী (সৌদামিনী দেবী : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা। স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।) জানিয়েছেন, “আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে চলিত আমরা মেয়েরা সেইদিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম। তখন বৎসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম।” এর জন্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পিসতুতো ভাই চন্দ্রমোহন একবার মহর্ষিকে অভিযোগ করে বলেন, “দেখ দেবেন্দ্র, তোমার বাড়ির মেয়েরা বাহিরের খোলা ছাদে বেড়ায়। আমরা দেখিতে পাই, আমাদের লজ্জা করে। তুমি শাসন করিয়া দাও না কেন?” দেবেন্দ্র কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়ির মেয়েদের কিছু বলা ঠিক বলে মনে করেননি। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে “বিজয়ার রাত্রে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোটবড় সকলের মধ্যে সদ্ভাবে কোলাকুলি” খুব প্রিয় ছিল। এ ছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিজয়ার দিন প্রত্যুষে আমাদের গৃহনায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিজয়ার গান করতে আসতেন।” অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “এরপরে বিজয়া। সেইটে ছিল আমাদের খুব আনন্দের দিন। সেদিনও কিছু কিছু পার্বণী মিলত। আমাদের বুড়োবুড়ো কর্মচারী যাঁরা ছিলেন যোগেশদাদা প্রভৃতিকে আমরা পেন্নাম করে কোলাকুলি করতুম। বুড়ো বুড়ো চাকরাও সব এসে আমাদের টিপটিপ করে পেন্নাম করত। তখন কিন্তু ভারি লজ্জা হত। খুশিও যে হতুম না তা নয়। কর্তামশায়কে কর্তাদিদিমাকে এ বাড়ির ও বাড়ির সকলেই প্রণাম করতে যেতুম। বরাবরই আমরা বড়ো হয়েও কর্তামশায়কে প্রতিবছর প্রণাম করতে যেতুম। তিনি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘আজ বুঝি বিজয়া’।” পরবর্তীকালে নিজেদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত ‘বিজয়া সম্মিলনী’ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বসত মস্ত জলসা। খাওয়া দাওয়া, আতর পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি। ঝাড়বাতি জ্বলছে। কিন্তু ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন।”
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালংকার সেই প্রতিমাকেই বিসর্জন দেওয়া হতো। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় পাচ্ছি, “...ভাসানের সময়েও সে গহনা খুলিয়া লওয়া হইত না সম্ভবত ভাসানের নৌকার দাঁড়ি মাঝি বা অন্য কর্মচারীরা তাহা খুলিয়া লইত, কিন্তু প্রতিমার গা-সাজানো গহনা আবার ঘুরিয়া ফিরিয়া বাড়িতে উঠিত না।” তত্ত্বাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হবার দশ বছর পরেও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের মতে, “দুর্গোৎসব আমাদের সমাজ-বন্ধন, বন্ধু-মিলন ও সকলের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রশস্ত উপায়। ইহার উপরে হস্তক্ষেপ করা উচিত হয় না; করিলে সকলের মনে আঘাত লাগিবে।” রবীন্দ্রনাথের কাছে বোধহয় নিজের ছোটোকাকার এই ধারণাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের ভার নিয়েছেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের বেদীতে অব্রাহ্মণ বসা নিয়ে একটি আলোচনা সূত্রে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ১৯১১ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বাংলার ১৩১৮ সালের ২৯শে ভাদ্র একটি চিঠিতে লিখেছেন, “যদি আদি সমাজে ব্রাহ্মণপূজাই চালাতে চান তবে তেত্রিশ কোটি কি অপরাধ করল? কে আমার নাম করে বলো পুতুলপূজা তেমন দোষের নয় কারণ তাকে ঝুসনড়ষ বলে গণ্য করা যায়, কিন্তু ব্রাহ্মণকে অন্যান্য সকল মানুষের চেয়ে পূজ্য বলে গণ্য করা ঈশ্বরের নিকট যথার্থ পাপ কারণ তাতে অন্যান্য মানবকে অপমান করা হয়, এই পাপ আমি আদি সমাজে কিছুতেই রাখতে দেব না।” বলা বাহুল্য, চিঠিখানি এই কারণে বিশেষ মূল্যবান, কারণ এর মধ্যে দিয়ে সমাজবিপ্লবী রবীন্দ্রনাথের বজ্রগম্ভীর বাণী আমাদের সচেতন করে তোলে।
৩.
অবর্ণনীয় দুঃখ আর অনির্বচনীয় আনন্দের ঠিক মাঝখানটিতে বাঙালি চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকে। জাতিগতভাবে এখানেই তার অনন্যতা, এখানেই তার অমরত্ব। এই কোজাগরী পূর্ণতার মধ্যেই সে তার মৃন্ময়ী জননীর মুখ দেখতে পায়। ক্ষুদ্রতায় ঘেরা তার গৃহকোণ তখন জীবনলীলার মহাঙ্গন হয়ে ওঠে। জগজ্জননী বসুন্ধরা হয়ে ওঠেন বিশ্বরূপা, ভয়ঙ্করী আদ্যশক্তি রূপান্তরিত হন শুভঙ্করীতে। এই জীবন প্রতিমতা থেকে জন্ম নেয় তার প্রতিমা। মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা। গার্হস্থ্য গরিমায় দেখা দেন মানবীমূর্তিতে। তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে দুর্গাপূজা খুবই স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে সর্বত্রই দূর্গা উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা দেখতে পাওয়া যায়। আগেই উল্লেখ করেছি, কবিতার মতোই বেশ কিছু ছোটো গল্পের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গকে স্থান দিয়েছেন। “দেনা পাওনা” গল্পের রামসুন্দর মিত্রকে আজও বহু মেয়ের বাবার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁদের দুর্ভাগা কন্যারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে এক নিদারুণ মানসিক এবং কখনও বা শারীরিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের অপরাধ কেন তাদের বাবারা পর্যাপ্ত পরিমাণে যৌতুক দিতে অপারগ। রামসুন্দর মিত্রের কন্যা নিরুপমাকেও তার শ্বশুরবাড়িতে ঐ অপরাধের জন্য এক অমানুষিক নির্যাতনের বলি হতে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে তার আদরের মেয়ে নিরুপমা কেমন আছে তা দেখতে গিয়ে রামসুন্দর মিত্রকে বারবার নিদারুণ অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অবশেষে, রামসুন্দর “মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন, ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না।” কিন্তু বাবার মন তো! দেখতে দেখতে পুজোর সময় এসে গেলে। রামসুন্দর আর স্থির থাকতে পারলেন না। “আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বলিলেন, ‘এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি’ খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন’।
পঞ্চমী কি যষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল, ‘দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস?’ বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনী আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই। রামসুন্দর তা জানিতেন এবং সে-সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসামান্য অলংকারে অনুগ্রহণপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, একথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হয় নাই।” রবীন্দ্রনাথ তার বেশ কিছু প্রবন্ধে দুর্গাপ্রসঙ্গ নানাভাবে আলোচনা করেছেন। বিষয়ের তাৎপর্য অনুযায়ী তার আলোচনার গভীরতাও বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। “লোকসাহিত্য”-র অন্তর্ভুক্ত “ছেলেভুলানো ছড়া” : প্রবন্ধটি একটি বহু প্রচলিত ছড়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেইজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বাংরবার শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান। অতএব সহজেই ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, আমাদের ছড়ার মধ্যে বঙ্গজননীর এই মর্মব্যথা নানা আকারে প্রকাশ পাইয়াছে।”
“আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে।
দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি, সংসার কাঁদায়ে॥
মা কাঁদেন, মা কাঁদেন ধূলায় লুটায়ে।
সেই-যে মা পলাকাটি দিয়েছেন গলা সাজায়ে॥
বাপ কাঁদেন, বাপ কাঁদেন দরবারে বসিয়ে।...”
৪.
রবীন্দ্রনাথের মানবধর্ম আবিষ্কার হঠাৎ করে হয়নি, এই আবির্ভাবের পিছনে কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা, দর্শন ও সংস্কৃতির বিবর্তন রয়েছে। এমনকি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টিশীল আদান-প্রদানের ইতিহাসের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহ ছিল বেশ গভীর। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, সমসাময়িকতায় আচ্ছন্ন অনেক ভারতীয় ইসলামের এই প্রভাবকে মেনে না নিলেও, হিন্দু ধর্মের বিবর্তনকে নিরপেক্ষভাবে দেখলে মহান ধর্ম ইসলামের সৃষ্টিশীল প্রভাবকে অস্বীকার করার কোনও উপায় থাকে না। তাই তিনি বারবার বলতেন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারে সম্রাট আকবরের উদার প্রয়াস রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাক্রমের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভারতের ইতিহাসকে জানা। আর এইজন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল সেই সব পণ্ডিতদের যাঁরা শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে গোঁড়ামিতে আবদ্ধ নন। তাই বাঙালির চিরন্তন উৎসব দুর্গোৎসবকে অতীব গুরত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। যাহোক রবীন্দ্রনাথের দুর্গাপূজা ভাবনায় লেখা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
বহু চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দুর্গা এবং দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে নানান বিষয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠিপত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলিতে ধর্মের ব্যাপারে তার বক্তব্য পরিস্ফুটিত হয়েছে।
১৯৩৪ সালের ২৫ এপ্রিল শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছেন : “...আমি যে জন্মব্রাত্য, শিশুকাল থেকেই আমি শ্রেণীভ্রষ্ট, এমনকি ব্রাহ্মসমাজও আমাকে খুঁটিতে বাঁধতে পারেনি। এইজন্যেই দেশের লোকের কাছ থেকে আমি প্রশংসা পেয়েছি প্রীতি পাইনি। কিন্তু বাঁধনের শর্তে প্রীতি যদি না পেয়ে থাকি তবে তা নিয়ে খেদ করব না।...”
১৯৩১ সালের ২৬ জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে হেমন্তবালা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন : “...আমি যে গৃহে জন্মেছি সেখানকার ধর্মেই দীক্ষা পেয়েছিলুম। সে ধর্মও বিশুদ্ধ। কিন্তু আমার মন তারই মাপে নিজেকে ছেঁটে নিতে কোনোমতেই রাজি ছিল না। তবু আমি এ নিয়ে টানা হেঁচড়া না করে বেশ সহজভাবেই আপন প্রকৃতির পথে চলেছিলুম। সেই পথ ধরেই আজ আমি নিজের উপযোগী গন্তব্যস্থানে পৌঁছেছি। এটাকে অপরাধ বলে মাথা খুঁড়ে মরি নি।...” এর পরের দিনই অর্থাৎ ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই হেমন্তবালাদেবীকে আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...কিন্তু একটি কথা মনে রেখ, চতুষ্পদে আমার চলা; সম্প্রদায়ের দুর্গে রুদ্ধদ্বারের মধ্যে আমি বাঁচি নে। এই জন্যে যদিও আমিও নিজের মত গোপন করি নে, তবু কাউকে ডাকাডাকি করে কোনদিন বলিনে আমার মত গ্রহণ করো। তুমি নিজের পথে নিজের মতে চললে তোমার প্রতি আমার স্নেহ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হবে এমন শঙ্কা কোনোদিন কোরো না।...” এই হেমন্তবালা দেবীকেই ১৯৩২ সালের ৮ নভেম্বর তারিখের আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...তোমার মা আমাকে ভুল বুঝেছেন। অবশ্য ধর্মমত আমার আছে কিন্তু কোনো সম্প্রদায় আমার নেই। আমি নিজেকে ব্রাহ্ম বলে গণ্যই করিনে। ...কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের দীক্ষা দেওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। কেননা আমি নিজেই যূথভ্রষ্ট, আমি ধর্মসমাজের তকমাপরা ছাপ-মারাদের মধ্যে কেই নই, রাজার দত্ত উপাধি আমি ত্যাগ করেছি সম্প্রদায়ের দত্ত উপাধিও আমার নেই।...” আবার, এই হেমন্তবালাদেবীর কন্যা বাসন্তী দেবীকে ১৯৩৩ সালের ৫ নভেম্বর তারিখের একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে প্রায় একই মতামত জানিয়ে লিখেছেন : “শুনে আশ্চর্য হবে তোমার সঙ্গে আমাদের ধর্মের অমিল নেই। আমি দীক্ষা নিই নি, নেবও না, আমার ভগবান কোনো সম্প্রদায়ের ছাঁচে ঢালা ভগবান নন।...”
তবে ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কার সবচেয়ে মূল্যবান অভিমতটি ব্যক্ত করেছেন হেমন্তবালা দেবীকে লিখিত ১৯৩৪ সালের ১৭ আগস্ট তারিখের একটি চিঠিতে। শান্তিনিকেতন থেকে ঐ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...তোমাদের সমাজের দিক থেকে আমি ব্রাত্য, আমি এক ঘরে, আমি অস্পৃশ্য। এই বর্জন আমার জীবনে দেবতার বরের মত কাজ করছে, এতে মানুষের অভিশাপ যদি লাগে, তবে তাতে সাপের নিঃশ্বাস লাগবে মাত্র বিষ লাগবে না।...” এই ভাবটিই প্রকাশ পেয়েছে “পত্রপুট”-এর পনেরো সংখ্যক কবিতায় :
১৬০০ সালে যখন রোমে জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মরণ - খুঁটিতে বেঁধে, তখনই আগ্রায় সর্বপ্রথম সম্রাট আকবরের আহ্বানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের আয়োজন ঘটছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, পারসিক, ইহুদি এমনকি নাস্তিকদেরও।
হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ,
পরিত্রাণ কর, -
ভেদচিহ্নের তিলক-পরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
হে মহান পুুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তোমাকে
তামসের পরপার হতে
আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা।...
আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন
সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে
মানবলোকে,
আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষ
আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।
ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই ধারণা বহুদিন আগেই গড়ে উঠেছে। তাই প্রচলিত পূজার্চানাবিধির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রবীন্দ্রনাথ বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। আমাদের দেশের পূজার্চনাবিধি সম্পর্কে এবং এর মূল্যবোধ সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা থাকলেও দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার করে এই পূজার্চনাবিধিকে যাতে কোনো কিছু কলুষিত না করে সে সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। তাই পুলিনবিহারী সেনকে ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বর একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ। একটি ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছিলেন যে, “একদিন আমার পরেলোকগত বন্ধু হেমচন্দ্র বসু মল্লিক বিপিন পাল মহাশয়কে সঙ্গে করে একটি অনুরোধ নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁদের কথা ছিল এই যে, বিশেষভাবে দুর্গামূর্তির সঙ্গে মাতৃভূমির দেবীরূপ মিলিয়ে দিয়ে তাঁরা শারদীয়া পূজার অনুষ্ঠানকে নূতনভাবে দেশে প্রবর্তিত করতে চান, তার উপযুক্ত ভক্তি ও উদ্দীপনামিশ্রিত স্তবের গান রচনা করবার জন্য আমার প্রতি তাঁদের বিশেষ অনুরোধ। আমি অস্বীকার করে বলেছিলুম, এ-ভক্তি আমার আন্তরিক হতে পারে না; সুতরাং এতে আমার অপরাধের কারণ ঘটবে। বিষয়টা যদি কেবলমাত্র সাহিত্যের ক্ষেত্রের অধিকারগত হত তাহলে আমার ধর্মবিশ্বাস যাই হোক আমার পক্ষে তাতে সংকোচের কারণ থাকত না; কিন্তু ভক্তির ক্ষেত্রে পূজার ক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশ গর্হণীয়। আমার বন্ধুরা সন্তুষ্ট হননি। আমি রচনা করেছিলুম ভূবনমনোমোহিনী, এ গান পূজামণ্ডপের যোগ্য নয় সে কথা বলা বাহুল্য।”
৫.
পুজোর সময়ে নামী লেখকদের লেখা পাবার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদকেরা পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এ কথা ছিল। নানান সম্পাদকের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাদের পত্রপত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য অনুরোধ আসত। যত দূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পুজোর লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হল প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ “শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা। ‘পাবর্ণী’ প্রথম শারদীয় বার্ষিকী হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’র সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন : “তোমার ‘পার্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভালো লাগিবে। তোমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের ঝুলি হইতে বাংলাদেশের ছেলেদের জন্য এই যে পার্বণী আদায় করিয়াছ ইহা একদিকে যত বড়োই দুঃসাধ্য কাজ অন্যদিকে ততবড়ই পুণ্য কর্ম। বস্তুত ইহার বৈচিত্র্য। সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার ভাবিবার বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধুলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে ইহা আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্যব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে। প্রথম খণ্ড পার্বণীতে যে আদর্শে ডালি সাজাইয়াছ বৎসরে বৎসরে তাহা রক্ষা করিতে পারিলে মা ষষ্ঠী ও মা সরস্বতী উভয়েরই প্রসাদ লাভ করিবে। আজকাল কাগজ প্রভৃতির দুর্মূল্যতার দিনে কেমন করিয়া দেড় টাকা দামে তুমি এই বই বাহির করিলে বুঝিতে পারিলাম না। বোধ করি সংগ্রহ করিবার উৎসাহে লাভ লোকসান খতাইয়া দেখিবার সময়ও পাও নাই। ইতি ৯ই আশ্বিন, ১৩২৫।”
১৯৩৫ সালে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পুজো সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘একশো টাকা বায়না’ দেওয়া হয়। ঘটনাটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালের ২৯ আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন “এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় দেশ ও আনন্দবাজারের দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্যে একশো টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেইজন্যে ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।...” শারদীয় সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা পাবার জন্য সম্পাদকের চেষ্টার অন্ত থাকত না। যে সম্পাদক তাঁর কাছ থেকে পুজোর লেখা আদায় করতে সক্ষম হতেন না তিনিও রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করতেন। এ ব্যাপারে কখনও কখনও উড়ো খবরও প্রচারিত হতো। যেমন, ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কাছে খবর এল যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি সে বছর পুজোতে সঞ্চয় ভট্টাচার্যের পত্রিকায় লেখা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে বুদ্ধদেব বসুকে শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট একটি চিঠিতে লিখলেন “নিজের কাজের ভিড় জমে উঠেছে তাছাড়া শরীর ক্লান্ত। লিখে ওঠা সম্ভব হবে না।
খোঁচার ঘায়ে খেজুরের গাছের অসম্মান করলে সে রস দেয়, বোধহয় এই গুজবটা রটে গেছে তাই সঞ্জীব ভট্টাচার্য তাঁর পুজোর সংখ্যক কাগজের জন্য আমার একখানা লেখা দাবি করেছেন আমি বিস্মিত।” চিঠিতে উল্লেখিত সঞ্জীব ভট্টাচার্য সম্ভবত সঞ্জয় ভট্টাচার্যই হবেন।
৬.
বিজয়া দশমী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা চিন্তা ও আগ্রহ কম ছিল না। সমস্ত রকমের ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং কুসংস্কারের বেড়াজালকে ভেদ করে রবীন্দ্রনাথ বিজয়ার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন। বিজয়ার কোলাকুলির মতো আনন্দ-উৎসব থেকে সরিয়ে রাখাকেও তাই রবীন্দ্রনাথ মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। এর কারণ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ নিজের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন : “শ্রীমান নগেন্দ্রনাথ, আমি ব্রাহ্ম এবং আমাদের পরিবার ব্রাহ্মধর্মে প্রথম দীক্ষিত। অতএব আমি যে ব্রাহ্মসমাজের বিরোধী কোনো উপদেশ দিব এমন সন্দেহ মনে স্থান দিয়ো না। বস্তুত উপদেশ দিতেই আমার প্রবৃত্তি নাই। যে সংস্কারের মধ্যে বাল্যকাল হইতে মানুষ হইয়াছে সে সংস্কার যে আমার কথাতেই দূর হইবে এরূপ আশা করাও অসঙ্গত। তুমি ধর্ম শোধনের পক্ষপাতী, হিন্দু সমাজের সমস্ত ভাল জিনিসকেও তাহার ধর্ম হইতে ছিন্ন করিয়া ব্রাহ্ম সমাজের কাঠামোর মধ্যে পুরিয়া তবে তোমার মন তৃপ্ত হয়, অথচ ইহাও দেখিয়াছি যে সমস্ত ব্যাপারে খৃষ্টানী ধর্মের সঙ্গে জড়িত তাহার প্রতি তোমার কোনো আশঙ্কা নাই অথচ খৃষ্টান ধর্মও ত্রিত্ববাদ, অবতারবাদের আকার এবং খৃষ্টধর্মের ঈশ্বর মানবগুণে আক্রান্ত। আমি কিন্তু বিজয়ার দিনেই দেশের সকল লোভের সঙ্গে কোলাকুলি করিতে সঙ্কুচিত হওয়াকে সঙ্কীর্ণতা মনে করি এই দিনের শুভদিনত্ব বহুদিন ও বহুজনের অন্তর হইতে জাগ্রত হইয়াছে। ইহা আমার বা কয়েকজনের পরামর্শ করা নূতন সৃষ্টি নহে এই দেশব্যাপাী সদ্ভাবের বন্যাকে যে ব্যক্তি প্রত্যাখ্যান করিতে পারে সে আর যাই করুক ধর্মের দোহাই যেন না দেয় যে ধর্ম্মের শিক্ষায় এই সমগ্র দেশের আলিঙ্গনকে উপেক্ষা করিতে উৎসাহিত করে তাহার মধ্যে এমন নিশ্চয় কিছু আছে যাহা ধর্ম্মে নহে যাহা দলীয় দম্ভ। পৌত্তলিককে সর্ব্বপ্রযতে বার করিবার চেষ্টা নিজের মধ্যে দৃঢ় থাক কিন্তু সেই দৃঢ়তা দুর্গপ্রাচীরের মতো তোমাকে অন্যের সঙ্গে এবং দেশের সঙ্গে মিশিতে যেন বাধা না দেয়। তাঁহারা ধর্ম শোধনের পক্ষপাতী কোনোপ্রকার ধর্মের দ্বারা কাহারো নিকটে আসিতে চায় না। হিন্দু সমাজের প্রতি তোমার মনের ভাবটাও সেইরূপ হিন্দুসমাজকে প্রশ্রয় দিলেই পৌত্তলিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। অতএব বিজয়ার দিনে কোলাকুলি করাটাতে যোগ দিতে চাও না এবং হোলির দিনে যদি কেহ তোমার হায়ে আবির দেয় তবে তোমার চক্ষু আবিরের চেয়ে রক্তবর্ণ হইয়া উঠে। ঈশ্বর করুন তাঁহার ধর্মের নাম করিয়া আমি যেন কোনো ধর্মের কোনো সম্প্রদায়ের সদ্ভাব বা আনন্দের উৎসব হইতে নিজেকে অনধিকারী করিয়া না রাখি। যদি তাহাদের কোনো অনুষ্ঠানে কোনো মূঢ়তা থাকে আমি যেন নিজের জ্ঞানবিশুদ্ধ চিত্তভাবের দ্বারাই সহজেই তাহার শোধন করিতে থাকি কোনো মতের উপদ্রবে আমার মনে যেন প্রেমের অভাব না ঘটে। আমি যখন শাক্ত সম্প্রদায়ের প্রতি আমার একটা অন্ধ বিরাগ না হয়, আমি যখন চৈতন্যকে ভক্তি করিতে পারি তখন যে বৈষ্ণবকে সর্বদাই দূরে রাখিতে চেষ্টা না করি। ব্রাহ্মধর্ম যেন কোনো ধর্মকে বিদ্বেষপরায়ণ সংস্কারের দ্বারা দূরে ঠেকাইয়া না রাখে, যেমন সমুদ্র নদীকে নিজের মধ্যে অসঙ্কোচ আকর্ষণ করিয়া তাহাকে মুক্তি দান করে তেমনি করিয়া সমস্ত ধর্মকেই প্রেমের সহিত নিজের মধ্যে গ্রহণ করিবার জন্য যেন আহ্বান করে। উপনিষদে বলেন যিনি ঈশ্বরকে অন্তরে গ্রহণ করেন তিনি ‘সর্ব্বমাবিবেশ’ তিনি সকলেই মধ্যে প্রবেশ করেন তাঁহার হৃদয় কাহাকেও বাধা দেয় না। ব্রাহ্মধর্মও সেই উপনিষদের ব্রহ্মের জ্ঞান সেই ব্রহ্ম সঙ্কীর্ণ দেবতা নহেন এই জন্য সকল ধর্মই ব্রাহ্মধর্মকে আশ্রয় করিয়া বৃহৎ হইতে পারে ব্রাহ্মধর্ম কোনো ধর্ম্মের নিকট সঙ্কুচিত হয় না। আমি তোমাকে নিজের মতে আনিবার জন্য তর্ক করিতেছি না ব্রাহ্মধর্ম বলিতে আমি কি বুঝি তাহার কিঞ্চিতমাত্র আভাস দিতে চেষ্টা করিলাম। এ কথা লইয়া অধিক বাদ প্রতিবাদ করিবার প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর যদি তোমার চিত্তকে নিজের ঔদার্যে ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ করিয়া তোমার সমস্ত সঙ্কোচকে দূর করিয়া দেন তোমাকে সহজে সকলের সঙ্গে আনন্দে ও সদ্ভাবে মিশিবার উপযুক্ত বিশাল প্রেমের অধিকারী করেন তবেই তুমি রিফর্মরের ঔদ্ধত্য ত্যাগ করিয়া ধার্মিকের নম্রতা লাভ করিতে পারিবে।...”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দুর্গাপুজো সামাজিক মিলনের একটি উদার ক্ষেত্রস্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। এখানে মলিনতা নেই, হীনতা নেই, নেই কোন ছোট-বড়র হিসেব কিংবা আভিজাত্যের বড়াই। এখানে সবাই সব ভুলে মিলবে, মেলাবে, ‘যাবে না ফিরে’। এখানে সবার আমন্ত্রণ রয়েছে।
১. ‘ধর্ম’ গ্রন্থের অন্তর্গত “উৎসব” প্রবন্ধটিতে লিখেছিলেন- উৎসবের দিন “একলার গৃহ সকলের গৃহ হয়, একলার ধন সকলের জন্য ব্যয়িত হয়। সেদিন ধনী দরিদ্রকে সম্মান করে, সেদিন পণ্ডিত মূর্খকে আসন দান করে। কারণ আত্মপর ধনী দরিদ্র পণ্ডিতমুর্খ এই জগতে একই প্রেমের দ্বারা বিধৃত হইয়া আছে। ইহাই পরম সত্য - এই সত্যের প্রকৃত উপলব্ধি পরমানন্দ। উৎসব দিনের অবধারিত মিলন এই উপলব্ধিরই অবসর। যে ব্যক্তি এই উপলব্ধি হইতে একেবারেই বঞ্চিত হইল, সে ব্যক্তি উন্মুক্ত উৎসব সম্পদের মাঝখানে আসিয়াও দীনভাবে রিক্তহস্তে ফিরিয়া চলিয়া গেল।”
২. ব্রাত্য হিসেবে ‘আবদ্ধ’ নি:সঙ্গতায় জীবন তো এই বংশটি যাপন করে আসছে শত শত বছর আগে থেকেই। নীলমণির ১৭৮৪ সালের নবযাত্রা থেকে ১৮৬১ সালে বিস্ময়কর রবীন্দ্রনাথের জন্ম পর্যন্ত ঠাকুর পরিবারের বিস্ময়কর উত্থান। নীলমণি ঠাকুরের তিন ছেলের মধ্যে বড় রামলোচন ও মেজ রামমণির বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণদিহির ‘আদি পিরালি’ বংশীয় রামকান্ত রায়চৌধুরীর দুই মেয়ে অলকা ও মেনকার সঙ্গে। রামলোচন-অলকা নিঃসন্তান ছিলেন। তাই মেনকা যখন পাঁচ বছরের রাধানাথ ও এক বছরের দ্বারকানাথকে রেখে মারা গেলেন, তখন জেঠামশায় রামলোচন ও জেঠাইমা (তথা মাসি) অলকা দত্তক নিয়ে নিলেন দ্বারকানাথকে।
৩. পলাশীর যুদ্ধের ১৭ বছর পরে, ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসন যখন একটু একটু করে কায়েম হতে আরম্ভ করেছে, সেই সময় ১৭৭৪ সালে রামমোহন রায়ের জন্ম হয়। ৩০ বছর বয়সে ১৮০৩-০৪ সালে রামমোহন লিখলেন তাঁর প্রথম বই ‘তুফাৎ উল মুয়োহাদিন’। বইটি রচিত ফার্সিতে, ভূমিকা আরবিতে। ১৮৮৪ সালে মৌলবী ওবেদুল্লা যখন বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ডি-ইস্ট বলা হয় তাঁদের যারা জগতের আদি কারণরূপে ঈশ্বরের কোনো হস্তক্ষেপ স্বীকার করেন না। এরকম ডি-ইস্ট ছিলেন বিলেতে নিউটন বা হিউম, ফরাসি দেশে ভলতেয়ার বা রুশো। আমাদের দেশের ১৯ শতকের যে দু’জন বিখ্যাত মানুষ তাঁদের দর্শন চিন্তায় ডি-ইস্ট বলে গণ্য হতে পারেন তাদের একজন অক্ষয় কুমার দত্ত অন্যজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অনেকেই এদের দু’জনকে নাস্তিক বলে জানেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের খুবই খুব গুরুত্ব দিয়ে তাঁর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এঁদের বিরুদ্ধে দেবেন্দ্রনাথের অভিযোগ- এবং বেশ গুরত্বপূর্ণ অভিযোগ যে এঁরা দু’জনেই নাস্তিক।
৪. ‘গোরা’ উপন্যাসে পরেশবাবু, আনন্দময়ী ও গোরার জবানীর মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মূর্তিপূজা এবং ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলিয়েছেন যা তার ব্যক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গে এক হয়ে যায়। আমি এ ধরনের তিনটি উক্তি এখানে উল্লেখ করছি।
(ক) পরেশবাবু সুচরিতাকে বলছেন : “সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিতে দেয়- মানুষ ব্রাহ্ম কি হিন্দু এই সমাজ-গড়া কথাটাকেই বিশ্ব সত্যের চেয়ে বড়ো করে তুলে একটা পাক তৈরি করে - এতক্ষণ মিথ্যা তাতে ঘুরে মরছিলুম।”
(খ) আনন্দময়ী সুচরিতাকে বলছেন : “তোমাদের ব্রাহ্মসমাজও কি মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলতে দেবে না? ঈশ্বর ভিতরে যাদের এক করেছেন তোমাদের সমাজ বাহির থেকে তাদের তফাত করে রাখবে? মা, যে সমাজে ছোটো অমিলকে মানে না, বড়ো মিলে সবাইকে মিলিয়ে দেয়, সে সমাজ কি কোথাও নেই? ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষ কি কেবল এমনি ঝগড়া করেই চলবে? সমাজ জিনিসটা কি কেবল এইজন্যেই হয়েছে?”
(গ) গোরা সুচরিতাকে বলছে : “ধর্ম সম্বন্ধে আমার নিজের কোনো বিশেষ সাধনা নেই, কিন্তু সাকারপূজা এবং পৌত্তলিকতা যে একই, মূর্তিপূজাতেই যে ভক্তিতত্ত্বের একটি চরম পরিণতি নেই, একথা আমি নিতান্ত অভ্যস্ত বচনের তো চোখ বুজে আওড়াতে পারব না। শিল্পে সাহিত্যে, এমনকি বিজ্ঞান ইতিহাসেও মানুষের কল্পনাবৃত্তির স্থান আছে, একমাত্র ধর্মের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই একথা আমি স্বীকার করব না। ধর্মের মধ্যেই মানুষকে সকল বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। আমাদের দেশের মূর্তিপূজায় জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে কল্পনার সম্মিলন হবার যে চেষ্টা হয়েছে সেটাতে করেই আমাদের দেশের ধর্ম কি মানুষের অন্যদেশের চেয়ে সম্পূর্ণতা সত্য হয়ে ওঠে নি?”
৫. ১৯৩৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে বুদ্ধদেব বসুকে একটি চিঠিতে লেখেন “অর্থের প্রযোজনে গল্প লিখতে হয়েছে। অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো সহজ পথ জানিনে বিপদে পড়লে সরস্বতীকে পান্ডা করে লক্ষ্মীর দরজায় যেতে হয়। সে লেখাটা বিক্রি করেছি।” রবীন্দ্রনাথ এই চিঠিতে ‘অর্থের প্রয়োজনে’ যে গল্প লেখার কথা বলেছে সে গল্পটি হল ‘রবিবার’। গল্পটি আনন্দবাজার পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় (২ আশ্বিন, ১৩৪৬ ) প্রকাশিত হয়।

পরনিন্দা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা...

পরনিন্দা পৃথিবীতে এত প্রাচীন এবং এত ব্যাপক যে, সহসা ইহার বিরুদ্ধে একটা যে-সে মত প্রকাশ করা ধৃষ্টতা হইয়া পড়ে। নোনা জল পানের পক্ষে উপযোগী নহে এ কথা শিশুও জানে – কিন্তু যখন দেখি সাত সমুদ্রের জল নুনে পরিপূর্ণ, যখন দেখি এই নোনা জল সমস্ত পৃথিবীকে বেড়িয়া আছে, তখন এ কথা বলিতে কোনো মতেই সাহস হয় না যে, সমুদ্রের জলে নুন না থাকিলেই ভালো হইত। নিশ্চয়ই ভালো হইত না, হয়তো লবণ জলের অভাবে সমস্ত পৃথিবী পচিয়া উঠিত।
তেমনি পরনিন্দা সমাজের কণায় কণায় যদি মিশিয়া না থাকিত তবে নিশ্চয়ই একটা বড়ো রকমের অনর্থ ঘটিত। উহা লবণের মতো সমস্ত সংসারকে বিকার হইতে রক্ষা করিতেছে।
পাঠক বলিবেন, “বুঝিয়াছি! তুমি যাহা বলিতে চাও, তাহা অত্যন্ত পুরাতন। অর্থাৎ, নিন্দার ভয়ে সমাজ প্রকৃতিস্থ হইয়া আছে।” একথা যদি পুরাতন হয় তবে আনন্দের বিষয়। আমি তো বলিয়াছি, যাহা পুরাতন তাহা বিশ্বাসের যোগ্য।
বস্তুত নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কী থাকিত? একটা ভালো কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না, সে ভালো কাজের দাম কী! একটা ভালো কিছু লিখিলাম, তাহার নিন্দুক কেহ নাই, ভালো গ্রন্থের পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কী হইতে পারে! জীবনকে ধর্মচর্চায় উৎসর্গ করিলাম, যদি কোনো লোক তাহার মধ্যে গূঢ় মন্দ অভিপ্রায় না দেখিল তবে সাধুতা যে নিতান্তই সহজ হইয়া পড়িল।
মহত্বকে পদে পদে নিন্দার কাঁটা মাড়াইয়া চলিতে হয়। ইহাতে যে হার মানে বীরের সদ্গতি সে লাভ করে না। পৃথিবীতে নিন্দা দোষীকে সংশোধন করিবার জন্য আছে তাহা নহে, মহত্বকে গৌরব দেওয়া তাহার একটা মস্ত কাজ।
নিন্দা-বিরোধ গায়ে বাজে না, এমন কথা অল্প লোকই বলিতে পারে। কোনো সহৃদয় লোক তো বলিতে পারে না। যাহার হৃদয় বেশি তাহার ব্যথা পাইবার শক্তিও বেশি। যাহার হৃদয় আছে সংসারে সেই লোকই কাজের মতো কাজে হাত দেয়। আবার লোকের মতো লোক এবং কাজের মতো কাজ দেখিলেই নিন্দার ধার চারগুণ শাণিত হইয়া উঠে। ইহাতেই দেখা যায়, বিধাতা যেখানে অধিকার বেশি দিয়াছেন সেইখানেই দুঃখ এবং পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন করিয়াছেন। বিধাতার সেই বিধানই জয়ী হউক। নিন্দা দুঃখ বিরোধ যেন ভালো লোকের, গুণী লোকের ভাগ্যেই বেশি করিয়া জোটে। যে যথার্থরূপে ব্যথা ভোগ করিতে জানে সে'ই যেন ব্যথা পায়। অযোগ্য ক্ষুদ্র ব্যক্তির উপরে যেন নিন্দা-বেদনার অনাবশ্যক অপব্যয় না হয়।
সরলহৃদয় পাঠক পুনশ্চ বলিবেন, “জানি, নিন্দায় উপকার আছে। যে লোক দোষ করে তাহার দোষকে ঘোষণা করা ভালো; কিন্তু যে করে না তাহার নিন্দায় সংসারে ভালো হইতেই পারে না। মিথ্যা জিনিসটা কোনো অবস্থাতেই ভালো নয়।”
এ হইলে তো নিন্দা টিঁকে না। প্রমাণ লইয়া দোষীকে দোষী সাব্যস্ত করা, সে তো হইল বিচার। সে গুরুভার কয়জন লইতে পারে, এবং এত সময়ই বা কাহার হাতে আছে? তাহা ছাড়া পরের সম্বন্ধে এত অতিরিক্ত মাত্রায় কাহারো গরজ নাই। যদি থাকিত তবে পরের পক্ষে তাহা একেবারেই অসহ্য হইত। নিন্দুককে সহ্য করা যায়, কারণ, তাহার নিন্দুকতাকে নিন্দা করিবার সুখ আমারও হাতে আছে; কিন্তু বিচারককে সহ্য করিবে কে?
বস্তুত আমরা অতি সামান্য প্রমাণেই নিন্দা করিয়া থাকি, নিন্দার সেই লাঘবতাটুকু না থাকিলে সমাজের হাড় গুঁড়া হইয়া যাইত। নিন্দার রায় চূড়ান্ত রায় নহে; নিন্দিত ব্যক্তি ইচ্ছা করিলে তাহার প্রতিবাদ না করিতেও পারে। এমন-কি, নিন্দাবাক্য হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়াই সুবুদ্ধি বলিয়া গণ্য। কিন্তু নিন্দা যদি বিচারকের রায় হইত তবে সুবুদ্ধিকে উকিল-মোক্তারের শরণ লইতে হইত। যাঁহারা জানেন তাঁহারা স্বীকার করিবেন, উকিল-মোক্তারের সহিত কারবার হাসির কথা নহে। অতএব দেখা যাইতেছে, সংসারের প্রয়োজন হিসাবে নিন্দার যতটুকু গুরুত্ব আবশ্যক তাহাও আছে, যতটুকু লঘুত্ব থাকা উচিত তাহারও অভাব নাই।
পূর্বে যে পাঠকটি আমার কথায় অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়াছিলেন তিনি নিশ্চয়ই বলিবেন, “তুচ্ছ অনুমানের উপরেই হউক বা নিশ্চিত প্রমাণের উপরেই হউক, নিন্দা যদি করিতেই হয় তবে ব্যথার সহিত করা উচিত-নিন্দায় সুখ পাওয়া উচিত নহে।”
এমন কথা যিনি বলিবেন তিনি নিশ্চয়ই সহৃদয় ব্যক্তি। সুতরাং তাঁহার বিবেচনা করিয়া দেখা উচিত – নিন্দায় নিন্দিত ব্যক্তি ব্যথা পায়, আবার নিন্দুকও যদি বেদনা বোধ করে, তবে সংসারে দুঃখবেদনার পরিমাণ কিরূপ অপরিমিতরূপে বাড়িয়া উঠে। তাহা হইলে নিমন্ত্রণসভা নিস্তব্ধ, বন্ধুসভা বিষাদে ম্রিয়মান, সমালোচকের চক্ষু অশ্রুপ্লুত এবং তাঁহার পাঠকগণের হৃদ্-গহ্বর হইতে দীর্ঘশ্বাস ঘন ঘন উচ্ছ্বসিত। আশা করি, শনিগ্রহের অধিবাসীদেরও এমন দশা নয়।
তাছাড়া সুখও পাইব না অথচ নিন্দা করিব, এমন ভয়ংকর নিন্দুক মনুষ্যজাতিও নহে। মানুষকে বিধাতা এতই সৌখিন করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন যে, যখন সে নিজের পেট ভরাইয়া প্রাণরক্ষা করিতে যাইতেছে তখনো ক্ষুধানিবৃত্তির ও রুচিপরিতৃপ্তির যে সুখ সেটুকুও তাহার চাই – সেই মানুষ ট্রাম ভাড়া করিয়া বন্ধুর বাড়ি গিয়া পরের নিন্দা করিয়া আসিবে অথচ তাহাতে সুখ পাইবে না, যে ধর্মনীতি এমন অসম্ভব প্রত্যাশা করে তাহা পূজনীয়, কিন্তু পালনীয় নহে।
আবিষ্কার-মাত্রেরই মধ্যে সুখের অংশ আছে। শিকার কিছুমাত্র সুখের হইত না, যদি মৃগ যেখানে-সেখানে থাকিত এবং ব্যাধকে দেখিয়া পলাইয়া না যাইত। মৃগের উপরে আমাদের আক্রোশ আছে বলিয়াই যে তাহাকে মারি তাহা নহে, সে বেচারা গহন বনে থাকে এবং পলায়নপটু বলিয়া তাহাকে কাজেই মারিতে হয়।
মানুষের চরিত্র, বিশেষত তাহার দোষগুলি, ঝোপঝাপের মধ্যেই থাকে এবং পায়ের শব্দ শুনিলেই দৌড় মারিতে চায়, এইজন্যই নিন্দার এত সুখ। আমি নাড়ী-নক্ষত্র জানি, আমার কাছে কিছুই গোপন নাই, নিন্দুকের মুখে এই কথা শুনিলেই বোঝা যায়, সে ব্যক্তি জাত-শিকারি। তুমি তোমার যে অংশটা দেখাইতে চাও না আমি সেইটাকেই তাড়াইয়া ধরিয়াছি। জলের মাছকে আমি ছিপ ফেলিয়া ধরি, আকাশের পাখিকে বাণ মারিয়া পাড়ি, বনের পশুকে জাল পাতিয়া বাঁধি – ইহা কত সুখের! যাহা লুকায় তাহাকে বাহির করা, যাহা পালায় তাহাকে বাঁধা, ইহার জন্য মানুষ কী না করে!
দুর্লভতার প্রতি মানুষের একটা মোহ আছে। সে মনে করে যাহা সুলভ তাহা খাঁটি নহে, যাহা উপরে আছে তাহা আবরণমাত্র, যাহা লুকাইয়া আছে তাহাই আসল। এইজন্যই গোপনের পরিচয় পাইলে সে আর-কিছু বিচার না করিয়া প্রকৃতের পরিচয় পাইলাম বলিয়া হঠাৎ খুশি হইয়া উঠে। এ কথা সে মনে করেন যে, উপরের সত্যের চেয়ে নীচের সত্য যে বেশি সত্য তাহা নহে; এ কথা তাহাকে বোঝানো শক্ত যে, সত্য যদি বাহিরে থাকে তবুও তাহা সত্য এবং ভিতরে যেটা আছে সেটা যদি সত্য না হয় তবে তাহা অসত্য। এই মোহবশতই কাব্যের সরল সৌন্দর্য অপেক্ষা তাহার গভীর তত্ত্বকে পাঠক অধিক সত্য বলিয়া মনে করিতে ভালোবাসে এবং বিজ্ঞ লোকেরা নিশাচর পাপকে আলোকচর সাধুতার অপেক্ষা বেশি বাস্তব বলিয়া তাহার গুরুত্ব অনুভব করে। এইজন্য মানুষের নিন্দা শুনিলেই মনে হয় তাহার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া গেল। পৃথিবীতে অতি অল্প লোকের সঙ্গই আমাকে ঘরকন্না করিতে হয়, অথচ এত-শত লোকের প্রকৃত পরিচয় লইয়া লাভটা কী? কিন্তু প্রকৃত পরিচয়ের জন্য ব্যগ্রতা মানুষের স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম, সেটা মনুষ্যত্বের প্রধান অঙ্গ, অতএব তাহার সঙ্গ বিবাদ করা চলে না; কেবল যখন দুঃখ করিবার দীর্ঘ অবকাশ পাওয়া যায় তখন এই ভাবি যে, যাহা সুন্দর, যাহা সম্পূর্ণ, যাহা ফুলের মতো বাহিরে বিকশিত হইয়া দেখা দেয়, তাহা বাহিরে আসে বলিয়াই বুদ্ধিমান মানুষ ঠকিবার ভয়ে তাহাকে বিশ্বাস করিয়া তাহাতে সম্পূর্ণ আনন্দ ভোগ করিতে সাহস করে না। ঠকাই কি সংসারে চরম ঠকা?
না-ঠকাই কি চরম লাভ?
কিন্তু এ-সকল বিষয়ের ভার আমার উপরে নাই, মনুষ্যচরিত্র আমি জন্মিবার বহু পূর্বেই তৈরি হইয়া গেছে। কেবল এই কথাটা আমি বুঝিবার ও বুঝাইবার চেষ্টায় ছিলাম যে সাধারণত মানুষ নিন্দা করিয়া যে সুখ পায় তাহা বিদ্বেষের সুখ নহে। বিদ্বেষ কখনোই সাধারণভাবে সুখকর হইতে পারে না এবং বিদ্বেষ সমস্ত সমাজের স্তরে স্তরে পরিব্যপ্ত হইলে যে বিষ হজম করা সমাজের অসাধ্য। আমরা বিস্তর ভালো লোক নিরীহ লোককেও নিন্দা করিতে শুনিয়াছি; তাহার কারণ এমন নহে যে সংসারে ভালো লোক, নিরীহ লোক নাই – তাহার কারণ এই যে, সাধারণত নিন্দার মূল প্রস্রবণটা মন্দভাব নয়।
কিন্তু বিদ্বেষমূলক নিন্দা সংসারে একেবারেই নাই, একথা লিখিতে গেলে সত্যযুগের জন্য অপেক্ষা করিতে হয়। তবে সে নিন্দা সম্বন্ধে অধিক কথা বলিবার নাই। কেবল প্রার্থনা এই যে, এরূপ নিন্দা যাহার স্বভাবসিদ্ধ সেই দুর্ভাগাকে যেন দয়া করিতে পারি।

রবীন্দ্র মনন ও সাহিত্যে বৌদ্ধ চেতনা...

'একদিন বুদ্ধ গয়াতে গিয়েছিলাম মন্দির দর্শনে। সেদিন এই কথা আমার মনে জেগেছিল - যাঁর চরণ স্পর্শে বসুন্ধরা একদিন পবিত্র হয়েছিল, তিনি যেদিন সশরীরে এই গয়াতে গমন করেছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাইনি, সমস্ত শরীর মন দিয়ে প্রত্যক্ষ তাঁর পুণ্যপ্রভাব অনুভব করিনি?' রবীন্দ্রনাথের এ কথাগুলো গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করে, যাঁকে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের স্বীকৃতি দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যে বুদ্ধকে অর্ঘ্য দিয়েছিলেন; মানবতার পূর্ণ মহিমায় বিকশিত সে মহামানব, যিনি ক্ষুদ্র একটি পার্থিব রাজ্য বিসর্জন দিয়ে মৈত্রী, প্রেম ও করুণার আদর্শে বিশ্বমানবের হৃদয় সাম্রাজ্য অধিকার করেছিলেন চিরকালের জন্য, তাঁর প্রতি ছিল কবির অন্তরের সমর্পণ।
বাঙালি আর্যেতর রক্তসদ্ভূত জাতি ও আদি শিব শক্তির উপাসক ও আগম নির্গমের পথেই তাঁর অস্তিত্বের ইতিহাস। খৃস্টপূর্ব তিন-চার অব্দে অর্থাৎ মৌর্য সম্রাটদের আমলে উত্তর ভারত থেকে বাংলার মাটিতে আসে বৌদ্ধ ধর্মের অভিঘাত এবং খিস্টীয় চার-পাঁচ অব্দে অর্থাৎ গুপ্ত সম্রাটদের আমলে আসে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব। এই দুয়ে মিলে বাংলার সমাজে সাত আটশো বছরে যে চেহারা থাকে, তার কেন্দ্রস্থানে থেকে যায় সেই পুরনো তান্ত্রিকতা ও লোকায়ত চেতনার ধর্ম। তবে গুপ্তযুগের অন্তর্বর্তী সময়টা বাদ দিলে অশোক থেকে হর্ষবর্ধন পর্যন্ত হাজার বছরের অধিককাল বৌদ্ধধর্ম রাজধর্ম হিসেবেই বহাল ছিল এবং এ ধর্মের বিপ্লবী চেতনা ভোঁতা করার জন্য রাজণ্যবর্গ, ব্রাহ্মণ ও শ্রেষ্ঠীরা দলে দলে ঢোকেন সংঘরামে। অতঃপর নবম শতাব্দীতে শংকরাচার্যের নেতৃত্বে হিন্দু পুনর্ভ্যুদয়ে বৌদ্ধধর্মের ভিত্তিমূল খসে পড়ায় বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত অব্রাহ্মণ হিন্দুরা পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরে গিয়ে পূর্বাবস্থা অপেক্ষা নিম্নস্তর বর্ণে অচ্ছুৎ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কিন্তু উনিশ শতকে বাংলায় যে বৌদ্ধমতের পুনরুজ্জীবন হয় তা সিদ্ধযোগী ও অবধূতদের মতো গুহায়িত বৌদ্ধধর্ম নয়। রাজেন্দ্রলাল মিত্র, অক্ষয় কুমার দত্ত, রামদাস সেন, অঘোরনাথ গুপ্ত, রমেশচন্দ্র দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেকেই বুদ্ধকে গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করে নৈষ্ঠিক শাস্ত্র ও টিকা-টিপ্পনী অনুসরণ করে। আবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, যিনি চর্যাপদের আবিষ্কারক এবং কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, হাড়িপা, সিদ্ধাই, মচ্ছেন্দ্রনাথ ও গোখনাথাদির আদি স্বরূপের ব্যাখ্যা করেন। অর্থাৎ দেড় হাজার বছরের অধিককালব্যাপী ভারত ও ভারতের বাইরে বুদ্ধকে ঘিরে মহাযান, হীনযান, বহুযান ও সহজানের যে নানামুখি বিকাশ ঘটে তা নিয়ে পণ্ডিতজনের মাঝে চলে অন্তহীন চর্চা, আলোচনা ও গবেষণা। আবার সাধারণ বাঙালিরা বুদ্ধদেবকে গ্রহণ করে অবতাররূপে। বাঙালা সাহিত্যে বুদ্ধের উপর অবতার আরোপের জন্য গিরিশ ঘোষ লেখেন, 'বুদ্ধদেব চরিত' এবং নবীন চন্দ্র সেনের 'অমিতাভ'। রমেশচন্দ্র দত্ত, বিবেকানন্দ ও বঙ্কিমচন্দ্রের কণ্ঠে থাকে এর ধারাবাহিক সমর্থন। সাধু অঘোরনাথ ও মহেশচন্দ্র ঘোষ বৌদ্ধ ধর্মের ওপর আরোপ করেন ব্রাহ্মণত্ব এবং উভয় ধর্মের মধ্যে পার্থক্যহীনতা প্রমাণ করার প্রয়াস থাকে গবেষণাতে। ইতিহাসের দৃষ্টিতে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু ধর্মের উৎস থেকে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধতাই এই ধর্মের জাগরণের একটি প্রধান কারণ।
ব্রাহ্মণ্যধর্মের একক আধিপত্যে জটিল ক্রিয়াকা-বহুল যাগযজ্ঞে সাধারণ মানুষ ছিল শাস্ত্রবিধি, প্রথা ও আর্যদের নিকট সমর্পিত এবং যুক্তি বুদ্ধিহীন ও সত্য বিস্মৃত। ধর্ম যখন এত বেশি আড়ম্বরপ্রিয় ও অনুষ্ঠাননির্ভর হয় তখন সাধারণের পক্ষে তা হয়ে পড়ে অপালনযোগ্য। এছাড়া অবতার গ্রহণ ও বর্জনে থাকে বিশ্বাসগত সামপ্রদায়িকতা। এক্ষেত্রে অবতারের মূল মন্ত্রই থাকে উপেক্ষিত। এমনি ধর্মীয় সমাজে জন্ম নিয়ে সিদ্ধার্থ মানুষের মুক্তি কামনায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিদ্রোহী হন। যাগযজ্ঞ ও বাহ্য আড়ম্বরের বিরোধিতা করেন এবং প্রচলিত আচার অনুষ্ঠান বর্জন করেন। ধর্ম সাধনার আনুষ্ঠানিক বাহ্যিকতা তার কাছে হলো অগ্রহণীয়। ধর্মসাধানায় মানব কল্যাণমুখি পথের অভিযাত্রী হয়ে তিনি মানুষকে আহ্বান জানালেন। ইহলোক ও পরলৌকিক সুখ কামনায় যাগযজ্ঞ ও পশুবলিকে তিনি বর্জন করলেন। ইন্দ্রিয় সংযম, চরিত্র গঠন, মৈত্রী ও করুণার মাধ্যমে মোক্ষপ্রাপ্তির বা নির্বাণ লাভের বাণী শোনালেন জগতকে।
বহুকাল পর (শ্রাবণ ১২৯২) রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধে বলেন:- ঈশ্বরকে আমরা হৃদয়ের সংকীর্ণতাবশত সীমাবদ্ধ করিয়া ভাবিতে পারি, কিন্তু পৌত্তলিকতায় তাঁহাকে বিশেষ একরূপ সীমার মধ্যে বদ্ধ করিয়া ভাবিতেই হইবে। অন্য কোন গতি নাই।... কল্পনা উদ্রেক করিবার উদ্দেশ্যে যদি মূর্তি গড়া যায় ও সেই মূর্তির মধ্যেই যদি মনকে বদ্ধ করিয়া রাখি তবে কিছুদিন পরে সে মূর্তি আর কল্পনা উদ্রেক করিতে পারে না। ক্রমে মূর্তিটাই সর্বেসর্বা হইয়া উঠে। এভাবেই ব্রাহ্মসমাজের মধ্য থেকে তার প্রথম জীবনের ধর্মবোধের জন্ম। ক্রমে ক্রমে ব্রাহ্মসমাজের গণ্ডি থেকে বিশ্বধর্মের আঙিনায় হেঁটে বুদ্ধের ধর্ম আদর্শের এক মৌলিক বিন্দুতে এসে রবীন্দ্রনাথ একসময় মিশে যান। অন্ধ আচারনির্ভর ভেদবাদের সংকীর্ণতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ধর্ম ও ধর্মতন্ত্রের পার্থক্য নির্ণয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন, ধর্মবলে, যে মানুষ যথার্থ মানুষ সে যে ঘরেই জন্মাক পূজনীয়। ধর্মতন্ত্র বলে যে মানুষ ব্রাহ্মণ সে যতবড় অভাজনই হোক, মাথায় পা তুলিবার যোগ্য। অর্থাৎ মুক্তির মন্ত্র পড়ে ধর্ম, আর দাসত্বের মন্ত্র পড়ে ধর্মতন্ত্র।
বুদ্ধদেব এই ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী ও সে সময়কার ব্রাহ্মণ্যবাদপুষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিদ্রোহী। তিনি সত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তিনটি শর্তের উল্লেখ করেন:
পরিশুদ্ধ ও মুক্তির জন্য কর্মে মানুষের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
কর্মের স্বাধীনতার জন্য বুদ্ধির স্বাধীনতা প্রয়োজন।
বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য কোনো গ্রন্থের অধীনতাপাশে আবদ্ধ থাকা অপ্রয়োজনীয়।
বুদ্ধের এই তিনটি অঙ্গীকারাত্মক শর্ত ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিষ্ঠানিক ভিতে আঘাত করে বিশ্বাসের জায়গাটা ভেঙে দেয়। তাঁর ধর্ম হয় মানবমুখি ও কল্যাণব্রতী। তার কল্যাণবোধ করুণা আশ্রিত হয়ে ভেদাভেদ ভেংগে মানুষ মানুষকে খোঁজে, সীমানার গ-ি ভেংগে হিংসা, বিভেদ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মুক্ত আত্মার বিশ্বকে দেখে।
রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেবের মধ্যে কখনো অবতারের অস্তিত্ব খোঁজেননি। তিনি তাঁর মধ্যে দেখেন মানবমহিমার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। বুদ্ধদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেন:-
তারই শরণ নেব যিনি আপনার মধ্যে মানুষকে প্রকাশ করেছেন। যিনি সেই মুক্তির কথা বলেছেন, যে মুক্তি নঞর্থক নয়, সদর্থক, যে মুক্তি কর্মত্যাগে নয়, সাধুকর্মের মধ্যে আত্মত্যাগে, যে মুক্তি রাগ-দ্বেষ বর্জনে নয়, সর্বজীবনের প্রতি অপরিমেয় মৈত্রী সাধনায়। আজ স্বার্থক্ষুধান্ধ বৈশ্যবৃত্তির নির্মম নিঃসীম লুব্ধতার দিনে সেই বুদ্ধের শরণ কামনা করি।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও 'জন্মদিনে' (১৯৪১ সালে) কাব্যের ষষ্ঠ সংখ্যক কবিতায় কবি বলেন:
এ ধরায় জন্ম নিয়ে যে মহামানব
সব মানবের জন্ম সার্থক করেছে একদিন।
তাঁহারে স্মরণ করি জানিলাম মনে -
প্রবেশি মানবলোকে আশিবর্ষ আগে
এই মহাপুরুষের পুণ্যভোগী হয়েছি আমিও।
বুদ্ধের ত্যাগ ও প্রেমের বাণী উপনিষদের অমোঘ মন্ত্র 'তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা এক হয়ে আশ্রয় নেয় রবীন্দ্রনাথে। বর্তমানে লোভের অশুভ প্রবৃত্তিতে মানুষের সকল শ্রেয়োবোধ প্রেয়তে আচ্ছন্ন, জাতিতে জাতিতে বাধে স্বার্থের সংঘাত, মানুষের ন্যায়বোধ ও শুভবুদ্ধি ক্রমশ অপসৃয়মাণ। রবীন্দ্রনাথ তখন মুক্তির আশায় সর্বত্যাগী মুক্তির অগ্রদূত রাজপুত্র সিদ্ধার্থকে খোঁজেন। রাজসুখ ত্যাগী কোন সন্ন্যাসীর খোঁজে রবীন্দ্রনাথ অনাগ্রহী, দীনতম মানুষের দুঃখ মোচনকারী মানুষের মঙ্গল কামনায় সর্বত্যাগী বুদ্ধই তার প্রণম্য।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন ও কর্ম পরিচালিত হয়েছে উপনিষদের এক মহান বাণীকে ঘিরে 'মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্বনম্।' কারো ধনে লোভ করো না। কেন লোভ করবে না। যেহেতু সমস্ত কিছু এক সত্যের দ্বারা পরিব্যাপ্ত। ব্যক্তিগত লোভে সেই একের উপলব্ধির মধ্যে বাধা আনে। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা সেই একের থেকে যা আসছে তাকেই ভোগ করো। সমস্ত মানবসত্য ও মানবকল্যাণ ক্ষেত্রে এই একের সত্যই বড়। সেই একের যোগে উৎপন্ন যা কিছু তাকেই সকলে মিলে ভোগ করো।
জগত সংসারের মানুষের দুঃখে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ হলেন ব্যথিত। দুঃখ বিনাশের সন্ধানে তিনি তিনটি পথের সন্ধান পেলেন। জ্ঞান (সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প) সীল (সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা) ও সমাধি (সম্যক প্রযত্ন, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি) মাধ্যমে দুঃখ মোচনের পথ দেখান। প্রেম, করুণা, মৈত্রী দর্শনে তিনি বিশ্বমানবকে বাঁধেন এক মঙ্গললোকে। তখন মানুষের মধ্যে বসবাসরত আমি পরিবার, গ্রাম, দেশ ভূম-লস্থ প্রাণী ও জগতের স্বার্থে নিজের স্বার্থ হয়ে ওঠে ও সে তখন তার পরিধি অতিক্রম করে অনন্তে পৌঁছায়। নিজ স্বার্থসীমা ডিঙিয়ে সে তখন মুক্তির সীমানাকে স্পর্শ করে। বুদ্ধের এ চেতনা মনজগতের আত্মমুক্তি এবং আত্মমুক্তিকে বিশ্বমননে সংযুক্ত করে। প্রায়োগিকভাবে ভিক্ষুসংঘে ব্যক্তি সম্পত্তি উচ্ছেদ করে ভোগবস্তুতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর নির্দেশনা।
রবীন্দ্রনাথ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী বা মানবকল্যাণে ব্রতী হয়ে মহামানবরূপী বুদ্ধ হওয়ার মনবাসনা কখনো ভিতরে ভিতরে জাগ্রত করেননি। তিনি জগতের সৎ-অসৎ, সুন্দর-অসুন্দর, লোভ-ত্যাগের মধ্যেও ছিলেন নিরাশক্ত আনন্দ প্রত্যাশী। মঙ্গলময় চেতনা তার সারা জীবনের পথের ধ্রুবতারা। অসতো মা সদগময় / তমসো মা জ্যোর্তিগময়ঃ অসত্য থেকে সত্য নিয়ে যাও, অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাও - এ পথেই তিনি মিলতে চেয়েছেন মঙ্গললোকে ও বিশ্বলোকে। এ বিশ্বলোকের পথহারা পথে হাঁটতে হাঁটতেই তার বহুপথের একটা মিলে যায় বুদ্ধের দেখানো পথে।
তথ্যসূত্র :- ১। রবীন্দ্ররচনাবলী; ২। নির্বাণ - বিজন গোলদার।

রবীন্দ্র কাব্যে নারী ভাবনা...

‘কল্পনা’ (১৯০০) কাব্যের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ। ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর কাব্য ‘কল্পনা’। যে কাব্যে বিগত শতাব্দীর রেশ প্রাচীন ভারত এবং কালিদাসের কালের রোমন্থনে উপস্থাপিত ‘স্বপ্ন’ যার প্রতীক। সেই সময়ে রবীন্দ্র মানস শুধু প্রেম ও সৌন্দর্য সাধনায় তৃপ্ত থাকেনি, ধাবিত হয়েছে বৃহৎ আদর্শ ও মনুষ্যত্বের দিকে। ‘কল্পনা’ কাব্যে কবির মনন, ত্যাগ, বীর্য, সত্য, নিষ্ঠা, শাশ্বত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রেম- সৌন্দর্য কল্পনা প্রাচীন ভারতীয় পরিবেশের মধ্যে স্থাপন করেছেন। তবু ‘মার্জনা’ কবিতার নারী বর্তমান বিশ্বের প্রেয়সী। প্রিয়তমকে ভালোবেসে বলছে -
‘প্রিয়তম, আমি তোমারে যে ভালোবেসেছি,
... ......
রানীর মতন বসবো রতন আসনে,
বাঁধিব তোমারে নিবিড় প্রণয় শাসনে;
দেবীর মতন পুরাব তোমার বাসনা।’
‘খেয়া’ (১৯০৬)-তে যে আধ্যাত্ম বোধের সূচনা সেই বোধের চরম উৎকর্ষ সার্থকভাবে রূপায়িত ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০)-তে। ‘চৈতালী’ (১৯১২) কাব্যে আবার তাকে বাস্তব পৃথিবীর হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের চিত্র বর্ণনায় দেখা গেল। ‘দিদি’ কবিতার দিদি। ‘বড় ব্যস্ত সারা দিন’ ঘরকন্যার কাজে। তার কর্মব্যস্ততায় সে আর দিদি থাকেনি। কবির কাছে মনে হয়েছে, ‘‘জননীর প্রতিনিধি/কর্মভারে অবনত অতি ছোট ‘দিদি’।’’
‘পরিচয়’ কবিতাতেও দিদি যেন বিশ্ব জননী -
‘এক কক্ষে ভাই লয়ে, অন্য কক্ষে ছাগ,
দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ।
পশু শিশু, নর শিশু দিদি মাঝে পড়ে
দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয় ডোরে।।’
নারী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তি ধরা পড়েছে ‘চৈতালী’ কাব্যের ‘মানসী কবিতায়। কবি লিখেছেন -
‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোমা সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমা সূত্রে বুনিছে বসন।...
সে কারণে কবির মনে হয়েছে -
‘পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা,
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।’
‘খেয়া’, ‘চৈতালী’ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রকাশিত। এ সময়ে তাঁর স্বজন বিয়োগের ফলে উল্লেখযোগ্য কাব্য নেই। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে রবীন্দ্রনাথ যা রচনা করেছেন তা তাঁঁর ব্যক্তিগত কয়েকটি কারণে পূর্ববর্তী রচনা থেকে স্বতন্ত্র। স্ত্রী-কন্যা-নাতনির মৃত্যুতে তাঁর মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়ভাবে ধরা পড়েছে। ‘স্মরণ’ কাব্য কবির সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর স্মরণে লেখা। একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের গভীর দুঃখ-বেদনা এই কাব্যে একটি সর্বজনীন রসোপলব্ধির পর্যায়ে উন্নীত। কবি প্রিয়াকে মৃত্যুর পর উপলব্ধি করার যে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এর অনেকগুলো কবিতায়।
‘যুগল মিলন’ কবিতায় কবি বলেছেন -
‘মিলন সম্পূর্ণ আজি হল তোমা সনে,
এ বিচ্ছেদ-বেদনার নিবিড় বন্ধনে।’
‘উৎসর্গ’ (১৯১৪) কাব্যেও নারী কবির কাছে রহস্যময়ী। ‘ছল’ কবিতায় রহস্যময়ী এই নারীর ছলনায় কবির বক্তব্য -
‘তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি
এত লীলার ছল
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে
আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা
যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।’
কিন্তু নিজেকে আড়াল করা নারীর পক্ষে সব সময় সম্ভব হয় না। তাই তো ‘চেনা’ কবিতায় কবির প্রশ্ন -
‘আপনার তুমি করিবে গোপন কী করি
হৃদয় তোমার আঁখির পাতায় থেকে থেকে পড়ে ঠিকরি!’
বলাকা (১৯১৬) কাব্যের মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দীতে বাংলা কবিতায় নূতনত্ব আনলেন রবীন্দ্রনাথ। এ কাব্যে যৌবনের জয়গান ও গতিবেগের গুনগানই মূল কথা। ‘বলাকা’ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনা রীতি নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন শেষ পর্যায়ের কাব্যে তা-ই চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। এ কাব্যে বিশেষ কীভাবে নিবিশেষ হয়ে যায় তা প্রকাশ পেয়েছে ‘ছবি’ ‘শা-জাহান’ কবিতায়। ‘বলাকা’ কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘ছবি’। এতে দেখা যায় জীবনের কেন্দ্রস্থলে যে বস্তুটি স্থির সেটি তার কিশোর প্রেম, কবিত্বের অনুপ্রেরণার উৎস। ভাবনার অবলম্বন ‘নাহি জানে কেহ নাহি জানে/তব সুর বাজে মোর প্রাণে/কবির অন্তরে তুমি কবি/নও ছবি, নও শুধু ছবি।’
তার কিশোর জীবনের প্রেম মৃত্যুর আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। এখন সে শুধু ছবির স্থির রেখা বন্ধনে আবদ্ধ। জীবন প্রভাতে যাকে পেয়েছিলেন, মরণের অন্ধকারে যাকে আবার হারিয়েছেন তাকেই জীবনের পথ চলার অগোচরে বার বার উপলব্ধি করেছেন কবি।
‘বিস্মৃতির মর্মে বসি রক্তে মোর দিয়েছে যে দোলা।
‘শা-জাহান’ কবিতায় তুলে ধরা হয়েছে এমন এক সত্যকে যা চিরন্তন। চলার পথে জীবনের সমস্ত কিছুই পেছনে ফেলে যেতে হয়, এমন কি প্রেমকেও। সম্রাট শাহজাহান তাজমহলকে ‘কালের কপোল তলে’ ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল’ ‘এক বিন্দু অশ্রুজল’ রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শাহজাহানের জীবন, জীবনের মুহূর্তে আবদ্ধ থাকেনি বরং জীবনের অন্তবেদনা বস্তুরূপে তাজমহলের মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে এবং ‘তুচ্ছ করি জীবন মৃত্যুর ওঠাপড়া/যুগে যুগান্তরে কহিতেছে এক স্বরে/চির বিরহির বাণী নিয়া -
ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া।’
‘বলাকা’ কাব্যে কবির দৃষ্টি অনেক বাস্তবমুখী হয়েছে যার ফলে ‘পলাতক।’ (১৯১৮) কাব্যের মতো মানব জীবনের হাসি-কান্না এবং দৈনন্দিন সুখ-দুুঃখের জোয়ার-ভাটায় আন্দোলিত কাব্য রচনায় স্বাচ্ছন্দ্য হয়েছেন। ‘পলাতকা’র কবিতাগুলি সহজ জীবনের মধ্যে যে হাহাকার তারই প্রতিচ্ছবি। কবিতা ও কাহিনী যে এক সঙ্গে গাঁথা যেতে পারে, কবি তার পরিচয় দিলেন এ কাব্যে। গল্পগুলোর প্রতিপাদ্য বিচ্ছেদ, বিদায় এবং মৃত্যু। এ প্রসঙ্গে ‘মুক্তি’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক। এখানে মেয়েদেরকে সমাজের তথা রাষ্ট্রের বৃহৎ কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে রেখে তাকে আবদ্ধ করা হয়েছে অন্তঃপুরে এবং চালানো হচ্ছে নানাবিধ অত্যাচার।
অন্তঃপুর বাসিনী একত্রিশ বছর বয়সী নারী যখন রোগে শোকে পরপারে যাত্রা করতে বসেছে তখন তার মনে হয়েছে সে তো সামান্য নয়, তার একটি জীবন ছিল। আসন্ন মৃত্যুকে শিয়রে নিয়ে সে উপলব্ধি করে এই বিশ্ব জগৎ বছরের ছয় ঋতু বাইশ বছর ধরে এসেছে আবার চলেও গেছে। যাবার বেলায় বার বার বলেছে,
‘খোলরে দুয়ার খোল’। কিন্তু নিরানন্দ এই গৃহকোনের নাগপাশ ছিঁড়ে সে-বাণী প্রবেশ করতে পারেনি। রান্নাঘরের ধোঁয়া এবং অন্তঃপুরের অন্ধকার কারাগারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে গেছে। নয় বছর বয়সে এ সংসারে এসেছিল, বাইশ বছর ধরে ‘নামিয়ে চক্ষু মাথায় ঘোমটা’ টেনে সবার আবদার মিটিয়েছে, সবাই তাকে বলেছে, লক্ষ্মী সতী ভালো মানুষ অতি। আজ তার যাবার সময় কেবলই মনে হচ্ছে - আমি কি শুধু সতী লক্ষ্মী? আর কিছু নই?
‘জানলা দিয়ে চেয়ে আকাশ পানে
আনন্দে আজ ক্ষণে-ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে
আমি নারী, আমি মহীয়সী,
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না বীণায় নিদ্রাবিহীন রাতি
আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা/শশী।
মিথ্যা হ’ত কাননে ফুল ফোটা॥’
সে শুধু জানত ‘রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা’। সে আজ এই চাকাতে বাঁধা জীবন থেকে মুক্তি নিচ্ছে। মরণের মধ্যে পেতে চাইছে মুক্তি এবং স্বাধীনতার স্বাদ - এ জীবনে যা সে কোনো দিনই পায়নি। ‘স্বামী কর্তৃক অবহেলিত এই নারী চরম মুহূর্তে উপলব্ধি করিয়া গেল নারী জীবনের সার্থকতা মাতৃত্বে নয়, প্রেয়সীত্বে নয়, পত্নীত্বে নয় তাহার সার্থকতার ক্ষেত্র অস্তিত্বের মূলগত ক্ষেত্র নারীত্বে।’
...বিশ শতকের আধুনিকতা, বাংলার সুখ-দুঃখ, হাস্য-পরিহাস, আচার-সংস্কার, ভয়-লোভ-লজ্জা, তার শক্তি, তার ব্যর্থতা প্রায় সবই ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের এ সময়ে রচিত রচনাবলীতে। পুরুষের নির্বোধ দাম্ভিক আত্মকেন্দ্রিকতা তাও আছে, আছে বালিকা বধূর নিঃশব্দ বেদনা, আছে আত্মবশ আধুনিকতার দীপ্তমূর্তি।
নারী সম্পর্কে উনিশ শতকীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও ছিল। শ্রী প্রিয়লাল দাস লিখেছেন - ‘রবীন্দ্রনাথের রমণী প্রেমের সম্বন্ধে বলিবার যদি কিছু থাকে, তাহা হইলে বলিতে হয় যে, এই প্রেমের চিত্রে বাঙালি বাবু প্রেমের পবিত্র মন্দিরে দেবতা সাজিয়া বসিয়া আছেন, আর দারুণ বুভুক্ষায় পীড়িতা বাঙালিনী ক্ষুধাতুর হৃদয় লইয়া দ্বার হইতে ফিরিয়া যাইতেছেন।
‘কেন রে চাস ফিরে ফিরে চলে আয়রে চলে আয়
এরা প্রাণের কথা বোঝে না যে.../হৃদয় কুসুম দলে যায়।’
বাঙালির মেয়েরা রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতায় কেবল হায় হায় করিয়া কাঁদিয়াই সারা -
‘না সজনি না, আমি জানি জানি সে আসিবে না।
এমন কাঁদিয়ে পোহাইবে যামিনী; বাসনা তবু পুরিবে না।’
অন্যত্র বলেছেন -
‘ওলো রেখে দে, সখি; রেখে দে,/মিছে কথা ভালবাসা!
সুখের বেদনা সোহাগ যাতনা/বুঝিতে পারি না ভাষা/ ...পরের সুখের হাসির লাগিয়া/অশ্রু সাগরে ভাসা।
জীবনের সুখ খুঁজিবারে গিয়া/জীবনের সুখ নাশা।’
অনুতপ্ত রবীন্দ্রনাথ নিজের মতাদর্শ পরিবর্তনের অঙ্গীকারে লিখেছেন -
‘শতবার ধিক্ আজি আমারে সুন্দরী/তোমারে হেরিতে চাহি এত ক্ষুদ্র করি। তোমার মহিমা জ্যোতি তব মূর্তি হতে/আমার অন্তরে পড়ি ছড়ায় জগতে।’
যাহোক, সব মিলিয়ে ‘কল্পনা’ থেকে ‘পলাতকা’ পর্যন্ত রবীন্দ্রকাব্য সাধনায় নারী ভাবনা একটি বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়ে ক্রমাগত এগিয়ে গেছে।
কবির ভাষায় ‘পুরবী’ (১৯২৫) যেন ‘বিধবা সন্ধ্যার নীরব অশ্রু মোচন’। তাই ‘পূরবী’তে অস্তরাগ উদ্ভাসিত জীবন শেষে জীবনের স্মৃতিচারণ থাকলেও বাস্তব নারী চিত্র এখানে দুর্লভ। তবে ‘মহুয়া’ (১৯২৯) এর ব্যতিক্রম। এখানে নারী তার অধিকার সম্বন্ধে সচেতন। ‘মহুয়া’ কাব্যের ‘সবলা’ কবিতায় নারী তার স্বাধিকারের প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে -
‘নারীরে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার?
হে বিধাতা -
যাব না বাসর ঘরে বাজায়ে কিঙ্কিনী
আমারে প্রেমের বীর্যে কর অশঙ্কিনী।’
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গদ্য কবিতায় সার্থকতার পরিচয় দিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘পরিশেষ’ (১৯৩২) কাব্যের ‘বাঁশি’ কবিতায় গদ্য ছন্দে যে নারীকে তুলে ধরলেন সে নারী তার কলমের সোনার পরশে হয়ে উঠল অনন্যা, অসামান্য।
‘এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলি লগ্নে/সেই খানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তাল তমালের ঘন ছায়া -
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা করে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।’
‘পুনশ্চে’র (১৯৩২) সাধারণ মেয়ে শরৎ বাবুকে অনুরোধ করেছে তাকে নিয়ে একটি গল্প লিখতে, সাধারণ মেয়ের গল্প, তাকে পাঠিয়ে দেয়া হোক সমঝদার এবং দরদীদের দেশে। সেখানে তাকে নিয়ে আলোচনা হবে শুধু বিদূষী বলে নয়, নারী বলে। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মেয়ে নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। তার মনে হয় কৃপণ বিধাতা তাকে সম্পূর্ণরূপে সৃষ্টি করেননি। সামান্য মেয়ে সৃষ্টি করে বিধাতা শক্তির অপচয় করেছেন। নারী হৃদয়ের এসব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ নারীকে পুরুষের পাশাপাশি এনে দাঁড় করিয়ে স্বাধিকারের স্বপক্ষে তার জোরালো অবস্থান ঘোষণা করেছেন। পুরুষ নিজেই প্রতিজ্ঞার ভাষায় বলছে -
‘আমরা দু’জনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরনীতে
মুগ্ধ ললিত অশ্রু গলিত গীতে॥...
কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয়, তুমি আছ, আমি আছি।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্নপালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ, আমি আছি।...
এই গৌরবে চলিব এভাবে যতদিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী তুমি আছ, আমি আছি।’
পদ্য ও গদ্য রচনার বৈচিত্র্যে রবীন্দ্র সাহিত্য অতুলনীয়। তবুও একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। তাঁর প্রেরণার উৎস অনেককাল আগ থেকে অনেকেই খুঁজেছেন কিন্তু তাঁর কাব্য রচনার পরমার্থ ও স্তর ভেদ নিয়ে বিচার ও বিশ্লেষণের কিছু অবকাশ রয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্রগ্রন্থ পরিচয়’ প্রকাশ করে এ বিষয়ে নতুন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এবং তিনি তাঁর পরিশিষ্টে কবির শুরুর প্রথম মুদ্রিত কবিতা হিসেবে ‘অভিলাষ’ এর নাম উল্লেখ করেছেন। এটি ১৮৭৪ সালের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় যখন এটি ছাপা হয় তখন কবির বয়স ১৩ বছর ৬ মাস। কিন্তু কবিতাটি তার অন্তত এক বছর আগে লেখা। কারণ লেখকের নাম না দিয়ে শুধু দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত এইটুকু কবিতার সাথে জুড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কবিতাটি ছাপিয়ে দেন। এছাড়া ১৭৯৭ শকে ‘প্রকৃতির খেদ’ শীর্ষক আর একটা কবিতাও বালকের রচিত বলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ওই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথই যে রবীন্দ্র প্রতিভার আসল জহুরী ছিলেন সে বিষয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কবি নিজেও বারবার সে কথা স্বীকার করেছেন। রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সেই তরুণ বয়সেই যে দাদার সহকর্মী ছিলেন সেটা জানা যায়। ব্রজেন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জুলাই ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘পূরু বিক্রম’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের একটা গান কিছুটা অদলবদল করে জুড়ে দেন। একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্র মন/এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন/আসুক সহস্র বাঁধা বাধুক প্রলয়/আমরা সহস্র প্রাণ রহিব নির্ভয়/...। ১৮৭৫ সালের ৩০ নভেম্বর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ-দ্বিগুণ’ গানটি বসানো হয়। রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক বেনামী রচনা রয়ে গেছে। ঠিকতম অনুসন্ধান করলে হয়তো বেরিয়ে আসবে। ‘অভিলাষ’ কবিতার মত আর একটি বেনামী কবিতা ড. সুকুমার সেন ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ তৃতীয় সংস্করণ ১৩৪৯, ১২৮০’র মাঘ সংখ্যার ‘বঙ্গদর্শন’ থেকে উদ্ধার করেছেন। প্রকাশের তারিখ অনুসারে এই ‘ভারত ভূমি’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের সর্ব প্রথম প্রকাশিত রচনা বলে হয়ত গণ্য হতে পারে। কবিতাটি যে বছর বঙ্গদর্শনে মাঘ মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৮৭৪) ছাপা হয়। সেই ১২৮০ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বপ্ন প্রয়াণে’ প্রথম সর্গও বঙ্কিমচন্দ্র ছাপেন। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায় যে, দ্বিজেন্দ্রনাথই বালক কবি রবীন্দ্রনাথের ‘ভারত ভূমি’ প্রকাশের জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকে দিয়েছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ১২ বছর ছিল বলে তাঁর দাদা নিশ্চিত করে জানালেও বঙ্কিমের মন্তব্যে, চর্তুদশ বর্ষীয় বালকের রচনা কি করে ছাপালেন বোঝা যায় না। কয় মাস পরে অভিলাষ ছাপার সময় মেজ দাদা স্পষ্ট দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের উল্লেখ করে গেছেন। এক্ষেত্রে ভারত ভূমি কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের না হয়ে বঙ্কিমের পরিচিত ১৪ বছরের অন্য কোন বালক কবিরও হতে পারে। ‘ভারত ভূমি’ সম্বন্ধে ড. সুকুমার সেনের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা বঙ্কিমের দ্বারা সংশোধিত হইয়াছিল বলিয়া ইহার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়িয়া গিয়াছে। বঙ্কিম চন্দ্রের সংশোধনের জন্য আমরা দুঃখিত নই, কিন্তু তিনি যে কবিতাটির অংশত ছাটিয়েছিলেন সে জন্য ক্ষোভ হইতেছে। কবিতাটি অসন্দিগ্ধভাবে বালক রবীন্দ্রনাথের বলে প্রমাণ হলে এর মধ্যে পাব বঙ্কিমচন্দ্রের গভীর সহানুভূতি ও অন্তর দৃষ্টির পরিচয়।’
রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যা সঙ্গীত প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালের ৫ জুলাই। রবীন্দ্রানাথের কবি প্রতিভার সম্পর্কে বঙ্কিম চন্দ্রের অভিব্যক্তিতে একবার তিনি রমেশকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘রমেশ তুমি সন্ধ্যা সঙ্গীত পড়িয়াছ?’ রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যার বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁকে বঙ্কিমচন্দ্র যখন এই প্রশ্নচ্ছলে রবীন্দ্রনাথের কাব্যলক্ষ্মীর স্থায়ী প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত করেন তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স বিশ-একুশ। তার আট নয় বছর আগেরকার রচনার মধ্যেও সে প্রতিভার সন্ধান পাওয়া বঙ্কিম ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ বঙ্কিম সে কালের কবিদের কড়া সমলোচকই ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর সম্পাদিত বঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ায় তাৎপর্য আরোও নতুন করে বোঝা যায়। ‘ভারত ভূমি’ কাঁচা রচনা হলেও কাব্য সরস্বতী পাদপীঠে শিশু রবীন্দ্রনাথের কচি হাতের প্রথম আল্পনা। সেই সঙ্গে কবির প্রথম দিকের রচনা ‘অচলিত সংগ্রহে’ প্রকাশিত তাঁর কাব্য রচনাগুলো এবং বিশেষ ভাবে মে ১৮৮৪-তে ছাপা তাঁর শৈশব সঙ্গীত ও ১৩০৩ সালের কাব্য গ্রন্থাবলীতে ছাপা ‘কৈশোরক’ পড়া উচিত। ১২৯১ সালে ছাপা হলেও শৈশব সঙ্গীতের অধিকাংশ কবিতা ১২৮৪-৮৭ সালে ভারতীতে প্রকাশিত হয় এবং সেগুলো কবির ১৩ থেকে ১৮ বছরের রচনা। রবীন্দ্রনাথকে ছেলেবেলায় বয়সের যে কিছু বড় দেখাত তার প্রমাণ তাঁর এগারো বছর বয়সে পিতার সঙ্গে প্রথম বোলপুর (১২৭৯) হয়ে অমৃতসর পর্যন্ত ট্রেন যাত্রার গল্পের মধ্যে আছে। সুতরাং ১২ বছরে রচিত ‘ভারত ভূমি’ কবিতাটি চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের বলে যে বঙ্কিম গ্রহণ করেন তারও খানিকটা কারণ মেলে।
সে যুগের এসব রচনা অচলিত সংগ্রহে স্থান না পেলেও তাদের সন্ধান করা দরকার। কারণ কবির ৫০ বছরে রচিত জীবনস্মৃতির মধ্যে তিনি নিজে অস্পষ্ট, অথচ মূল্যবান আভাস দিয়ে গেছেন তাঁর শিক্ষারম্ভ অধ্যায়ে।
‘তখনকর, খল প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি “জল পড়ে পাতা নড়ে”। আমার জীবনে এটিই আদি কবির প্রথম কবিতা’।
ছন্দ ঋত্বিক রবীন্দ্রনাথের ওপর ছন্দ সরস্বতীর সেই প্রথম আশীর্বাদ। এখনকার কালে যদি পাঁচ বছরে শিক্ষারম্ভ হয়ে থাকে তাহলে ছন্দ বোধের এই প্রথম উন্মেষ দেখি ১৮৬৬-৬৭ সালে। তখন প্রাক-কংগ্রেস যুগের প্রথম জাতীয় আন্দোলন বিখ্যাত হিন্দু মেলার উদ্বোধন চলছে (১২ এপ্রিল ১৮৬৭)। কবির পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ও দাদারা এ আন্দোলনে অগ্রণী। দেবেন্দ্রনাথের অর্থ সাহায্যে হিন্দু মেলার সহ-সম্পাদক নব গোপাল মিত্র ‘ন্যাশনাল পেপার’ ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’ সত্যেন্দ্রনাথের ‘জয় ভারতের জয়’ (১৮৬৮) গণেন্দ্রনাথের ‘লজ্জায় ভারত যশ গাইব কি করে’ রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়রে’ ও হেমচন্দ্রের ‘বিংশতি কোটি মানুষের বাম’ (১২৭৭ এডুকেশন গেজেট ১৭ শ্রাবণের সখ্যায় মুদ্রিত)। ‘ভারত সঙ্গীত’ প্রভৃতি গান ও কবিতা রবীন্দ্রনাথের শৈশব রচনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তার সন্ধান কবি নিজে দিয়েছিলেন। একেবারে হারিয়ে যাওয়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন নীল হাতা বাঁধানো লেট্স ডায়রি নিবন্ধ রচনা ও অধূনা লুপ্ত ‘পৃথ্বীরাজের পরাজয়’ কাহিনীর মধ্যে। এই বীর রসাত্মক কাব্যটি প্রথম বোলপুর ভ্রমণের ‘তৃণহীন কংকর শয্যায়’ লেখা হয়। কিন্তু কাব্যে হাতেখড়ি হয়েছিল তার ৭-৮ বছরে। অর্থাৎ ১৮৮৮-৮৯ সালে। যখন তাঁর ভাগিনেয় জ্যোতি প্রকাশ হ্যামলেটের উক্তি আবৃতি করতেন ও পয়ার ছন্দে চৌদ্দ অক্ষরে যোগাযোগের রীতি পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়ে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নব যুগের উদ্বোধন করেন। মধুসূদন সে কালের সাহিত্য গগনে মধ্যাহ্ন সূর্য ও তিনি কবির মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ও বিলাত প্রবাসের সহযাত্রী। সত্যেন্দ্রনাথের মারফতে আমরা জানি যে, দেবেন্দ্রনাথ মাইকেলের মস্ত সমজদার ছিলেন ও তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু রাজনারায়ণ বসু মাইকেলের সহপাঠী ও সমালোচক ছিলেন। তাই মাইকেলের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কারণে ভারতীতে নিজ নামে পদ্য ও গদ্য রচনা ছাপার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাধ বধ’ কাব্যকে আক্রমণ করেন। মাইকেলের প্রভাব ‘ভারত ভূমি’ কবিতায় স্পষ্ট এবং তারও আগে মেজদাদা শিশু কবির রচনা নবগোপাল মিত্রকে শুনিয়েছিলেন। তখন ভ্রমরকে অবজ্ঞাভরে তাড়িয়ে কবি দ্বিরেক প্রয়োগে গর্বিত। সুতরাং ভারত ভূমি কবিতার ‘পুরন্দর’ শব্দের সঙ্গে ক্ষপাকর মেলান রবীন্দ্রনাথেরও কীর্তি হতে পারে, অথবা বঙ্কিমের?
ভাগিনেয় যখন হেমলেট আবৃতিতে মত্ত তার কিছু কালের মধ্যে ম্যাকবেথ নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ আজীবন সেক্সপিয়ার ভক্ত এবং প্রায় ৮০ বছর বয়সেও তাঁকে হ্যামলেট আবৃতি করতে শুনা গেছে। উত্তর ভারত ভ্রমণ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তিনি আনন্দ চন্দ্র বেদান্তবাগিশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে ‘কুমার সম্ভব’ ও ম্যাকবেথ পড়তেন। শুধু তাই নয় (১৮৭৩-৭৪) সালে ম্যাকবেথ বাংলা ছন্দে তর্জমা না করা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গুরু তাকে ঘরে বন্দি করে রাখতেন। সেই অনুবাদের কিছু অংশ কবির সংস্কৃত অধ্যাপক রাম সর্বস্ব পণ্ডিত বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শোনান। তখন রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁর কাছে ছিলেন। এই অনুবাদের খণ্ডিত অংশ মাত্র রক্ষা পেয়েছে। ভারতী ১২৮৭ আশ্বিন থেকে তা সজনীকান্ত দাস উদ্ধার করেন। অভিলাষ কবিতার ২৪ থেকে ৩১ পদগুলোতে তার ছায়া দেখা যায়।
‘ভারত ভূমি’ কবিতার সঙ্গে যোগ হয়েছে এ কালের তাঁর স্বাক্ষরিত ও অধূনা সুপরিচিত অন্য দু’একটা রচনায় ১৮৭৫ ফেব্রুয়ারিতে পঠিত ও প্রকাশিত ‘হিন্দু মেলার উপহার’ ও ১৮৭৭ ডিসেম্বর হিন্দুমেলার দ্বিতীয় কবিতা ‘লিটন দরবার’ উপলক্ষে। এ সম্বন্ধে ব্রজেন্দ্রনাথ তার ‘রবীন্দ্রগ্রন্থ পরিচয়ে’ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ও যতিনাথ ঘোষ জ্যোতিরিন্দ্রের ‘স্বপ্নময়ী’ নাটকে (১৮৮২) একটা কবিতার সঙ্গে এর ভাবগত মিল দেখিয়েছেন। এসব রচনার মধ্যে হেমচন্দ্র ও রঙ্গলালের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। হিন্দু মেলার প্রথম ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ ও দ্বিতীয় ডিসেম্বর ১৮৭৬ কবিতার মাঝখানে আরও একটি মূল্যবান কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। ‘প্রকৃতির খেদ’ ‘তত্ত্ব বোধিনী’ পত্রিকায় আষাঢ় ১৮৭৫ জুন-জুলাই ছাপা হয় অভিলাষ কবিতাটি। কবিতাটি ছাপার আট মাস পরে ‘অভিলাষ’ ৩-৪ পদে, যেমন ‘ভারত ভূমি’র ছাপ কতকটা বহন করছে। তেমনি, ‘প্রকৃতির খেদ’ অনেক জায়গায় রবীন্দ্রনাথের ‘বনফুল’ কাব্যোপন্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বই হিসাবে ১৮৮০’র নয় মার্চে প্রকাশিত হলেও বনফুলের কবিতাগুলো ১৮৮২-৮৩ সালে শ্রীকৃষ্ণদাস সম্পাদিত ১২৭৮ আরম্ভ ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ ও ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রে প্রকাশিত হয়। হিন্দু মেলার প্রথম স্বাক্ষরিত কবিতা প্রকাশেরর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স তের বছর নয় মাস এবং ‘প্রকৃতির খেদ’ ছাপার সময় তাঁর বয়স চৌদ্দ বছর দুই মাস ছিল। এই কবিতাটির ভাব ও ভাষার সাহায্যে ‘বনফুল’ (১২৮২) ও ‘কবি কাহিনী’ ১২৮৪ যেন এক নতুন রূপে দেখা যায়। এছাড়া ১২৮৪ শ্রাবণে ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কবির ছদ্ম নামে ‘ভানু সিংহের পদাবলী’ প্রথম কিস্তি সাতটি পদ ছাপা হয়। তার প্রায় পাঁচ বছর আগে (১২৭৯-৮০) সারদা চরণ ও অক্ষয় সরকার প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ প্রকাশ করেন এবং সেটি কবির লোভের সামগ্রী হয়েছিল সেকথা তিনি তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখে গেছেন। মৈথিলী ভাষায় বিদ্যাপতি পাঠ ও ‘কৃত্রিম’ ব্রজবুলিতে ভানু সিংহ রচনার জের অনেককাল রবীন্দ্রনাথ টেনেছেন তার প্রমাণ মেলে। বৈষ্ণব পদাবলীর ঝংকার তাঁর কাব্যে ও গানে কি নতুন রস দিয়েছে এবং মৈথিলী ব্রজবুলির চর্চা থেকে শব্দতত্ত্বের নেশা তাঁকে কেমন করে পেয়ে বসেছিল তার আলোচনা আরো দরকার। তাঁর কাঁচা বয়সের কিছু পদ্য অনুবাদ লুকিয়ে আছে অনেক গদ্য প্রবন্ধের মধ্যে। ১৮৮৫ ‘ভারতী’ পত্রিকায় দান্তে ‘ওবিয়েতিচ’ প্রবন্ধে আলোচনায় কিছু কিছু পদ্য অনুবাদ পাওয়া যায়। ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলাত যাত্রা করেন। তখন হয়ত তাঁর প্রথম ছাপা বই ‘কবি কাহিনী’র ফাইল তাঁর হাতে ছিল। ওই সময়ে পাওয়া যায় তাঁর একটা গান ‘জয় জয়ন্তী’ যেটি স্বদেশীযুগে বহুদিন ধরে আদৃত হয়েছিল, ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু দেহ/তোমারই তরে মা সঁপিনু প্রাণ’। এগান স্মরণ করিয়ে দেয় বিদেশ যাত্রার সময় মধুসূদনের ‘রেখ মা দাসেরে মনে’। অথচ ১২৮৪-তে ভারতীতে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘনাদ’ সমালোচনা। এবং তারও দু’বছর আগে জ্ঞানাঙ্কুর (১২৮২) পত্রে ভুবন মোহিনী প্রতিভার বিশ্লেষণ। সুতরাং, পদ্যে ও গদ্যে রবীন্দ্র প্রতিভা ছেলেবেলায় যে আত্মপ্রকাশ করেছিল সেকথা মনে রেখে এসব কাঁচা লেখা গুলো ধৈর্য্যরে সাথে নতুন করে পড়া দরকার।
যে মুলোটা বাড়ে তার পাতা দেখলে যেমন বোঝা যায়, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে একজন বড় কবি হবেন তার প্রমাণ ছেলে বেলাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বার বছর বয়সের একটা কিশোর তাঁর মধ্যে কবি হওয়ার যে বাসনা তা সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করে। এর মূলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা অপরিসীম। রবীন্দ্র পরিবার সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গণে সে সময় সারা বাংলায় বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সে প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হয়েছিল নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আমাদের স্বভাব আমরা একটি প্রস্ফুটিত ফুলকে দেখে খুশি হই, তার সুবাস নিতে উদগ্রীব হই, কিন্তু বুঝতে চাইনা একটা পূর্ণ বিকশিত ফুল হতে হলে তাকে কত কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এটা সুস্পষ্ট। যদিও তাঁর ছেলেবেলার সাহিত্য সাধনার কথা এখনও অনেকের কাছে অজ্ঞাত প্রায়। সময় এসছে রবীন্দ্র প্রতিভা বিকাশের। দরকার আরো একটু চেষ্টা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :-
১। প্রথমনাথ বিশী/রবীন্দ্র সরণ।
২। রবীন্দ্র প্রতিভার প্রাথমিক অনুষঙ্গ/
এনায়েত আলী বিশ্বাস।

শান্তিনিকেতনে ঠাকুর পরিবারের ব্যবহৃত আসবাবপত্র... শান্তিনিকেতন গৃহ...






রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় দুর্গোৎসব...

বাঙালিদের সব থেকে অন্যতম বড় উৎসব দুর্গোৎসব। কিন্তু কেন? দেখা যায়, দুর্গোৎসব বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বিশেষ করে হিন্দু বাঙালিদের কাছে সবচ...