বাঙালিদের সব থেকে অন্যতম বড় উৎসব দুর্গোৎসব। কিন্তু কেন? দেখা যায়, দুর্গোৎসব বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বিশেষ করে হিন্দু বাঙালিদের কাছে সবচেয়ে বড় উৎসব। দেবী দুর্গার পুত্র-কন্যাদের মধ্যে একেকজন পৃথকভাবে ভারতের নানাদিকে পূজিত, যেমন মহারাষ্ট্রে গণেশের পূজার গুরুত্ব অনেক বেশি। লক্ষ্মী, সরস্বতীরও ভক্তসংখ্যা কম নয়। কিন্তু সমস্ত পুত্র-কন্যা সমেত, সিংহ বাহিনী, অসুরদলনী দুর্গা এক চালচিত্রে গ্রথিতরূপে অন্যত্র কোথাও পুজিত হন না। এখানেই বাঙালির দুর্গোৎসবের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট। অনেকের মুখে শোনা যায়, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে বর্তমান আকারে মৃন্ময়ী মুর্ত্তিতে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব প্রচলিত হয়েছে। অর্থাৎ তার আগে বর্তমান আকারে মৃন্ময়ীমূর্তিতে দুর্গাপূজা হতো না; ইতিহাসের বিচারে তা মোটেই সত্য নয়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজ রাজত্বের প্রথমভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর স্মার্ত্তপ্রবর রঘুনন্দন ন্যূনতম চারশত বছর আগে শ্রীমন্মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সময় প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। রঘুনন্দনের দুর্গোৎসবতত্ত্ব, দুর্গাপূজাতত্ত্ব ও দুর্গাপ্রয়োগতত্ত্ব পাঠ করলেই স্পষ্টই বোধ হয়, তৎকালে বর্তমান আকারে মৃন্ময়ীমূর্তিতেই শারদীয়া দুর্গাপূজা হত এবং তাহার ব্যবস্থা ও পদ্ধতির জন্যে এই তিনখানা গ্রন্থ লিখে গিয়েছিলেন। ঈশ - সত্তার মাতৃরূপের ভজনা ও পূজা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রচলিত। সর্বজনীনতার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে দুর্গোৎসবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মঙ্গল ও হিতকামনায় এমন বৃহত্তর আয়োজন সত্যিই অনন্য। যারা নিরাকার সাধনায় বিশ্বাস করেন, তাদেরও এই উৎসব নানাভাবে অপ্রত্যক্ষে আহ্বান করে। অবশ্য শ্রদ্ধার সঙ্গে, আত্যন্তিক প্রয়োজনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরকে গতানুগতিক অনুসন্ধান করতে চাননি। তাঁর সমগ্র ধ্যান ধারণা ও কর্মসাধনায় অনন্তের চৈতন্যই সমধিক গুরুত্ব পেয়েছে। গৃহ ও গৃহকাজের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছেন। আজ গোটা দুনিয়ার গবেষকরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা,গান, প্রবন্ধ, ছবিআঁকা নিয়ে গবেষণা করছেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। তাহলে বাঙালির চিরন্তন উৎসব দুর্গাপূজা নিয়ে তাঁর ভাবনা কী ছিল? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুর্গাপূজা ভাবনাটা আসলে বিশেষ জটিল। জটিল কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। এই লেখার ভিতরে কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথের যে উক্তিগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো মোটেই দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু বলা যায় সবিশেষ জটিল। কবিগুরু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, উৎসবের দিন একলার গৃহ সকলের গৃহ হয়। ১৯০৩ সালের ২২শে অক্টোবর বোলপুর থেকে কাদম্বিনী দেবীকে লেখা একটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, “সাকার নিরাকার একটা কথার কথামাত্র। ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর কেন আমরা প্রত্যেকেই সাকারও বটে নিরাকারও বটে। আমি এ সকল মতামত লইয়া বাদ-বিবাদ করিতে চাই না। তাহাকে রূপে এবং ভাবে, আকারে এবং নিরাকারে, কর্মে এবং প্রেমে সকল রকমেই ভজনা করিতে হইবে। আকার তো আমাদের রচনা নহে, আকার তো তাঁহার-ই।” এরও দুবছর পরে ১৯১২ সালের ১৮ মার্চ আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কাদম্বিনী দেবীকে লেখেন, “প্রতিমা সম্বন্ধে আমার মনে কোনো বিরুদ্ধতা নেই। অর্থাৎ যদি কোনো বিশেষ মূর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই কোনো মুস্কিল থাকে না। তাকে বিশেষ কোনো একটি চিহ্নদ্বারা নিজের মনে স্থির করে নিয়ে রাখলে কোনো দোষ আছে একথা আমি মনে করিনে। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনো মূঢ়তাকে পোষণ করলেই তার বিপদ আছে।” বস্তুতপক্ষে ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উদার মনোভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজেই কাদম্বিনী দেবীকে একবার লিখেছিলেন, “নানা ব্রাহ্ম সমাজ আমাকে ঠিক ব্রাহ্ম বলে গ্রহণ করেননি এবং আমাকে তাঁরা বিশেষ অনুকূল দৃষ্টিতে কোনোদিন দেখেননি। (চিঠিপত্র, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৮)। ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই ধারণা বহুদিন আগেই গড়ে উঠেছে। তাই প্রচলিত পূজার্চনাবিধির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রবীন্দ্রনাথ বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। আমাদের দেশের পূজার্চনাবিধি সম্পর্কে এবং এর মূল্যবোধ সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা থাকলেও দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার করে এই পূজার্চনাবিধিকে যাতে কোনো কিছু কলুষিত না করে সে সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। প্রসঙ্গত, এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এককালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল এবং তা হয় নীলমণি ঠাকুরের আমলে থেকেই। ১৭৮৪ সালের জুন মাস থেকে নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকোয় গোলপাতার ঘর করে বসবাস শুরু করেন। তখন অবশ্য জোড়াসাঁকোর নাম ছিল মেছুয়াবাজার। নীলমণি ঠাকুরের কন্যা কমলমণি গল্প করতেন যে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির “প্রথম দুর্গাপূজা খোলার ঘরে হয়”। বস্তুত দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোর সমারোহ কিন্তু শুরু হয়। তাঁর আমলে ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, সরস্বতীপুজো অনুষ্ঠিত হতো। তবে যেহেতু দ্বারকানাথ নিজে ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন, তাই পুজোয় জীববলি হত না। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “আমাদের বৈষ্ণব পরিবারে কী ভাগ্যি পশুবলির বীভৎস কাণ্ড ছিল না সেই রক্ষা, - পশুর বদল কুমড়ো বলি হয় এই শুনতুম।” এ প্রসঙ্গে তখনকার কালের সংবাদপত্রে এই খবরটি প্রকাশিত হয় যে, “শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহিত রামমোহন রায়ের আত্মীয়তা আছে কিন্তু রায়জী তাঁহার নিত্যকর্ম কিছুই রহিত করাইতে পারিয়াছেন তাহা কখনই পারিবেন না। ওই বাবুর বাটিতে দুর্গোৎসব, শ্যামপূজা, জগদ্ধত্রী পূজা ইত্যাদি তাবৎ কর্ম হইয়া থাকে।” দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর এক ভাষণে উল্লেখ করেছেন যে, “প্রথম বয়সে উপনয়নের পর প্রতিনিয়ত যখন গৃহেতে শালগ্রাম শিলার অর্চনা দেখিতাম, প্রতি বৎসর যখন দুর্গাপূজার উৎসবে উৎসাহিত হইতাম তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রাম শিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।”
২.
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপুজোর সময় ইচ্ছে করেই প্রবাসে কাটাতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “পুজোর সময় কোনও মতেই পিতা বাড়ি থাকিতেন না এজন্যই পুজোর উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না।”
“যষ্ঠীর দিন সবাইকে জিনিসপত্র ‘বিলি’ করে দেওয়া হত। শুধু ছেলেমেয়েরাই নয়, আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভৃত্য এবং ঝিয়েরাও নতুন জামাকাপড় পেতেন। এর পরে আসত পার্বণীর পালা। ...দ্বারকানাথ অত্যন্ত দরাজ ছিলেন এবং প্রচুর খরচ করতেন। এ সময়েই মোয়া, ক্ষীর প্রভৃতি মিশিয়ে একটি বৃহদাকার মেঠাই পুজোর সময় তৈরি করা হত এবং ফুটবলসদৃশ এই বিশাল মেঠাইয়ের স্মৃতি অনেকের মন থেকেই মিলিয়ে যায়নি।”
রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, “দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতুম, তাদের ধূপধুনা বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম, এত বাহ্য আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার আধ্যাত্মিক জিনিস।”
বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী (সৌদামিনী দেবী : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা। স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।) জানিয়েছেন, “আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে চলিত আমরা মেয়েরা সেইদিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম। তখন বৎসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম।” এর জন্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পিসতুতো ভাই চন্দ্রমোহন একবার মহর্ষিকে অভিযোগ করে বলেন, “দেখ দেবেন্দ্র, তোমার বাড়ির মেয়েরা বাহিরের খোলা ছাদে বেড়ায়। আমরা দেখিতে পাই, আমাদের লজ্জা করে। তুমি শাসন করিয়া দাও না কেন?” দেবেন্দ্র কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়ির মেয়েদের কিছু বলা ঠিক বলে মনে করেননি। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে “বিজয়ার রাত্রে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোটবড় সকলের মধ্যে সদ্ভাবে কোলাকুলি” খুব প্রিয় ছিল। এ ছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিজয়ার দিন প্রত্যুষে আমাদের গৃহনায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিজয়ার গান করতে আসতেন।” অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “এরপরে বিজয়া। সেইটে ছিল আমাদের খুব আনন্দের দিন। সেদিনও কিছু কিছু পার্বণী মিলত। আমাদের বুড়োবুড়ো কর্মচারী যাঁরা ছিলেন যোগেশদাদা প্রভৃতিকে আমরা পেন্নাম করে কোলাকুলি করতুম। বুড়ো বুড়ো চাকরাও সব এসে আমাদের টিপটিপ করে পেন্নাম করত। তখন কিন্তু ভারি লজ্জা হত। খুশিও যে হতুম না তা নয়। কর্তামশায়কে কর্তাদিদিমাকে এ বাড়ির ও বাড়ির সকলেই প্রণাম করতে যেতুম। বরাবরই আমরা বড়ো হয়েও কর্তামশায়কে প্রতিবছর প্রণাম করতে যেতুম। তিনি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘আজ বুঝি বিজয়া’।” পরবর্তীকালে নিজেদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত ‘বিজয়া সম্মিলনী’ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বসত মস্ত জলসা। খাওয়া দাওয়া, আতর পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি। ঝাড়বাতি জ্বলছে। কিন্তু ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন।”
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালংকার সেই প্রতিমাকেই বিসর্জন দেওয়া হতো। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় পাচ্ছি, “...ভাসানের সময়েও সে গহনা খুলিয়া লওয়া হইত না সম্ভবত ভাসানের নৌকার দাঁড়ি মাঝি বা অন্য কর্মচারীরা তাহা খুলিয়া লইত, কিন্তু প্রতিমার গা-সাজানো গহনা আবার ঘুরিয়া ফিরিয়া বাড়িতে উঠিত না।” তত্ত্বাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হবার দশ বছর পরেও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের মতে, “দুর্গোৎসব আমাদের সমাজ-বন্ধন, বন্ধু-মিলন ও সকলের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রশস্ত উপায়। ইহার উপরে হস্তক্ষেপ করা উচিত হয় না; করিলে সকলের মনে আঘাত লাগিবে।” রবীন্দ্রনাথের কাছে বোধহয় নিজের ছোটোকাকার এই ধারণাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের ভার নিয়েছেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের বেদীতে অব্রাহ্মণ বসা নিয়ে একটি আলোচনা সূত্রে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ১৯১১ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বাংলার ১৩১৮ সালের ২৯শে ভাদ্র একটি চিঠিতে লিখেছেন, “যদি আদি সমাজে ব্রাহ্মণপূজাই চালাতে চান তবে তেত্রিশ কোটি কি অপরাধ করল? কে আমার নাম করে বলো পুতুলপূজা তেমন দোষের নয় কারণ তাকে ঝুসনড়ষ বলে গণ্য করা যায়, কিন্তু ব্রাহ্মণকে অন্যান্য সকল মানুষের চেয়ে পূজ্য বলে গণ্য করা ঈশ্বরের নিকট যথার্থ পাপ কারণ তাতে অন্যান্য মানবকে অপমান করা হয়, এই পাপ আমি আদি সমাজে কিছুতেই রাখতে দেব না।” বলা বাহুল্য, চিঠিখানি এই কারণে বিশেষ মূল্যবান, কারণ এর মধ্যে দিয়ে সমাজবিপ্লবী রবীন্দ্রনাথের বজ্রগম্ভীর বাণী আমাদের সচেতন করে তোলে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপুজোর সময় ইচ্ছে করেই প্রবাসে কাটাতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “পুজোর সময় কোনও মতেই পিতা বাড়ি থাকিতেন না এজন্যই পুজোর উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না।”
“যষ্ঠীর দিন সবাইকে জিনিসপত্র ‘বিলি’ করে দেওয়া হত। শুধু ছেলেমেয়েরাই নয়, আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভৃত্য এবং ঝিয়েরাও নতুন জামাকাপড় পেতেন। এর পরে আসত পার্বণীর পালা। ...দ্বারকানাথ অত্যন্ত দরাজ ছিলেন এবং প্রচুর খরচ করতেন। এ সময়েই মোয়া, ক্ষীর প্রভৃতি মিশিয়ে একটি বৃহদাকার মেঠাই পুজোর সময় তৈরি করা হত এবং ফুটবলসদৃশ এই বিশাল মেঠাইয়ের স্মৃতি অনেকের মন থেকেই মিলিয়ে যায়নি।”
রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, “দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতুম, তাদের ধূপধুনা বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম, এত বাহ্য আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার আধ্যাত্মিক জিনিস।”
বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী (সৌদামিনী দেবী : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা। স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।) জানিয়েছেন, “আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে চলিত আমরা মেয়েরা সেইদিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম। তখন বৎসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম।” এর জন্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পিসতুতো ভাই চন্দ্রমোহন একবার মহর্ষিকে অভিযোগ করে বলেন, “দেখ দেবেন্দ্র, তোমার বাড়ির মেয়েরা বাহিরের খোলা ছাদে বেড়ায়। আমরা দেখিতে পাই, আমাদের লজ্জা করে। তুমি শাসন করিয়া দাও না কেন?” দেবেন্দ্র কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়ির মেয়েদের কিছু বলা ঠিক বলে মনে করেননি। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে “বিজয়ার রাত্রে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোটবড় সকলের মধ্যে সদ্ভাবে কোলাকুলি” খুব প্রিয় ছিল। এ ছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিজয়ার দিন প্রত্যুষে আমাদের গৃহনায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিজয়ার গান করতে আসতেন।” অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “এরপরে বিজয়া। সেইটে ছিল আমাদের খুব আনন্দের দিন। সেদিনও কিছু কিছু পার্বণী মিলত। আমাদের বুড়োবুড়ো কর্মচারী যাঁরা ছিলেন যোগেশদাদা প্রভৃতিকে আমরা পেন্নাম করে কোলাকুলি করতুম। বুড়ো বুড়ো চাকরাও সব এসে আমাদের টিপটিপ করে পেন্নাম করত। তখন কিন্তু ভারি লজ্জা হত। খুশিও যে হতুম না তা নয়। কর্তামশায়কে কর্তাদিদিমাকে এ বাড়ির ও বাড়ির সকলেই প্রণাম করতে যেতুম। বরাবরই আমরা বড়ো হয়েও কর্তামশায়কে প্রতিবছর প্রণাম করতে যেতুম। তিনি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘আজ বুঝি বিজয়া’।” পরবর্তীকালে নিজেদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত ‘বিজয়া সম্মিলনী’ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বসত মস্ত জলসা। খাওয়া দাওয়া, আতর পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি। ঝাড়বাতি জ্বলছে। কিন্তু ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন।”
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালংকার সেই প্রতিমাকেই বিসর্জন দেওয়া হতো। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় পাচ্ছি, “...ভাসানের সময়েও সে গহনা খুলিয়া লওয়া হইত না সম্ভবত ভাসানের নৌকার দাঁড়ি মাঝি বা অন্য কর্মচারীরা তাহা খুলিয়া লইত, কিন্তু প্রতিমার গা-সাজানো গহনা আবার ঘুরিয়া ফিরিয়া বাড়িতে উঠিত না।” তত্ত্বাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হবার দশ বছর পরেও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের মতে, “দুর্গোৎসব আমাদের সমাজ-বন্ধন, বন্ধু-মিলন ও সকলের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রশস্ত উপায়। ইহার উপরে হস্তক্ষেপ করা উচিত হয় না; করিলে সকলের মনে আঘাত লাগিবে।” রবীন্দ্রনাথের কাছে বোধহয় নিজের ছোটোকাকার এই ধারণাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের ভার নিয়েছেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের বেদীতে অব্রাহ্মণ বসা নিয়ে একটি আলোচনা সূত্রে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ১৯১১ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বাংলার ১৩১৮ সালের ২৯শে ভাদ্র একটি চিঠিতে লিখেছেন, “যদি আদি সমাজে ব্রাহ্মণপূজাই চালাতে চান তবে তেত্রিশ কোটি কি অপরাধ করল? কে আমার নাম করে বলো পুতুলপূজা তেমন দোষের নয় কারণ তাকে ঝুসনড়ষ বলে গণ্য করা যায়, কিন্তু ব্রাহ্মণকে অন্যান্য সকল মানুষের চেয়ে পূজ্য বলে গণ্য করা ঈশ্বরের নিকট যথার্থ পাপ কারণ তাতে অন্যান্য মানবকে অপমান করা হয়, এই পাপ আমি আদি সমাজে কিছুতেই রাখতে দেব না।” বলা বাহুল্য, চিঠিখানি এই কারণে বিশেষ মূল্যবান, কারণ এর মধ্যে দিয়ে সমাজবিপ্লবী রবীন্দ্রনাথের বজ্রগম্ভীর বাণী আমাদের সচেতন করে তোলে।
৩.
অবর্ণনীয় দুঃখ আর অনির্বচনীয় আনন্দের ঠিক মাঝখানটিতে বাঙালি চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকে। জাতিগতভাবে এখানেই তার অনন্যতা, এখানেই তার অমরত্ব। এই কোজাগরী পূর্ণতার মধ্যেই সে তার মৃন্ময়ী জননীর মুখ দেখতে পায়। ক্ষুদ্রতায় ঘেরা তার গৃহকোণ তখন জীবনলীলার মহাঙ্গন হয়ে ওঠে। জগজ্জননী বসুন্ধরা হয়ে ওঠেন বিশ্বরূপা, ভয়ঙ্করী আদ্যশক্তি রূপান্তরিত হন শুভঙ্করীতে। এই জীবন প্রতিমতা থেকে জন্ম নেয় তার প্রতিমা। মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা। গার্হস্থ্য গরিমায় দেখা দেন মানবীমূর্তিতে। তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে দুর্গাপূজা খুবই স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে সর্বত্রই দূর্গা উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা দেখতে পাওয়া যায়। আগেই উল্লেখ করেছি, কবিতার মতোই বেশ কিছু ছোটো গল্পের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গকে স্থান দিয়েছেন। “দেনা পাওনা” গল্পের রামসুন্দর মিত্রকে আজও বহু মেয়ের বাবার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁদের দুর্ভাগা কন্যারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে এক নিদারুণ মানসিক এবং কখনও বা শারীরিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের অপরাধ কেন তাদের বাবারা পর্যাপ্ত পরিমাণে যৌতুক দিতে অপারগ। রামসুন্দর মিত্রের কন্যা নিরুপমাকেও তার শ্বশুরবাড়িতে ঐ অপরাধের জন্য এক অমানুষিক নির্যাতনের বলি হতে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে তার আদরের মেয়ে নিরুপমা কেমন আছে তা দেখতে গিয়ে রামসুন্দর মিত্রকে বারবার নিদারুণ অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অবশেষে, রামসুন্দর “মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন, ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না।” কিন্তু বাবার মন তো! দেখতে দেখতে পুজোর সময় এসে গেলে। রামসুন্দর আর স্থির থাকতে পারলেন না। “আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বলিলেন, ‘এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি’ খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন’।
পঞ্চমী কি যষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল, ‘দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস?’ বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনী আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই। রামসুন্দর তা জানিতেন এবং সে-সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসামান্য অলংকারে অনুগ্রহণপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, একথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হয় নাই।” রবীন্দ্রনাথ তার বেশ কিছু প্রবন্ধে দুর্গাপ্রসঙ্গ নানাভাবে আলোচনা করেছেন। বিষয়ের তাৎপর্য অনুযায়ী তার আলোচনার গভীরতাও বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। “লোকসাহিত্য”-র অন্তর্ভুক্ত “ছেলেভুলানো ছড়া” : প্রবন্ধটি একটি বহু প্রচলিত ছড়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেইজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বাংরবার শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান। অতএব সহজেই ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, আমাদের ছড়ার মধ্যে বঙ্গজননীর এই মর্মব্যথা নানা আকারে প্রকাশ পাইয়াছে।”
অবর্ণনীয় দুঃখ আর অনির্বচনীয় আনন্দের ঠিক মাঝখানটিতে বাঙালি চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকে। জাতিগতভাবে এখানেই তার অনন্যতা, এখানেই তার অমরত্ব। এই কোজাগরী পূর্ণতার মধ্যেই সে তার মৃন্ময়ী জননীর মুখ দেখতে পায়। ক্ষুদ্রতায় ঘেরা তার গৃহকোণ তখন জীবনলীলার মহাঙ্গন হয়ে ওঠে। জগজ্জননী বসুন্ধরা হয়ে ওঠেন বিশ্বরূপা, ভয়ঙ্করী আদ্যশক্তি রূপান্তরিত হন শুভঙ্করীতে। এই জীবন প্রতিমতা থেকে জন্ম নেয় তার প্রতিমা। মাতৃপূজা হয়ে ওঠে মুক্তির পূজা, মানুষের পূজা। গার্হস্থ্য গরিমায় দেখা দেন মানবীমূর্তিতে। তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে দুর্গাপূজা খুবই স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে সর্বত্রই দূর্গা উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা দেখতে পাওয়া যায়। আগেই উল্লেখ করেছি, কবিতার মতোই বেশ কিছু ছোটো গল্পের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গকে স্থান দিয়েছেন। “দেনা পাওনা” গল্পের রামসুন্দর মিত্রকে আজও বহু মেয়ের বাবার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁদের দুর্ভাগা কন্যারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে এক নিদারুণ মানসিক এবং কখনও বা শারীরিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের অপরাধ কেন তাদের বাবারা পর্যাপ্ত পরিমাণে যৌতুক দিতে অপারগ। রামসুন্দর মিত্রের কন্যা নিরুপমাকেও তার শ্বশুরবাড়িতে ঐ অপরাধের জন্য এক অমানুষিক নির্যাতনের বলি হতে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে তার আদরের মেয়ে নিরুপমা কেমন আছে তা দেখতে গিয়ে রামসুন্দর মিত্রকে বারবার নিদারুণ অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অবশেষে, রামসুন্দর “মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন, ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না।” কিন্তু বাবার মন তো! দেখতে দেখতে পুজোর সময় এসে গেলে। রামসুন্দর আর স্থির থাকতে পারলেন না। “আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বলিলেন, ‘এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি’ খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন’।
পঞ্চমী কি যষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল, ‘দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস?’ বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনী আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই। রামসুন্দর তা জানিতেন এবং সে-সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসামান্য অলংকারে অনুগ্রহণপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, একথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হয় নাই।” রবীন্দ্রনাথ তার বেশ কিছু প্রবন্ধে দুর্গাপ্রসঙ্গ নানাভাবে আলোচনা করেছেন। বিষয়ের তাৎপর্য অনুযায়ী তার আলোচনার গভীরতাও বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। “লোকসাহিত্য”-র অন্তর্ভুক্ত “ছেলেভুলানো ছড়া” : প্রবন্ধটি একটি বহু প্রচলিত ছড়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেইজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বাংরবার শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান। অতএব সহজেই ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, আমাদের ছড়ার মধ্যে বঙ্গজননীর এই মর্মব্যথা নানা আকারে প্রকাশ পাইয়াছে।”
“আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে।
দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি, সংসার কাঁদায়ে॥
মা কাঁদেন, মা কাঁদেন ধূলায় লুটায়ে।
সেই-যে মা পলাকাটি দিয়েছেন গলা সাজায়ে॥
বাপ কাঁদেন, বাপ কাঁদেন দরবারে বসিয়ে।...”
দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি, সংসার কাঁদায়ে॥
মা কাঁদেন, মা কাঁদেন ধূলায় লুটায়ে।
সেই-যে মা পলাকাটি দিয়েছেন গলা সাজায়ে॥
বাপ কাঁদেন, বাপ কাঁদেন দরবারে বসিয়ে।...”
৪.
রবীন্দ্রনাথের মানবধর্ম আবিষ্কার হঠাৎ করে হয়নি, এই আবির্ভাবের পিছনে কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা, দর্শন ও সংস্কৃতির বিবর্তন রয়েছে। এমনকি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টিশীল আদান-প্রদানের ইতিহাসের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহ ছিল বেশ গভীর। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, সমসাময়িকতায় আচ্ছন্ন অনেক ভারতীয় ইসলামের এই প্রভাবকে মেনে না নিলেও, হিন্দু ধর্মের বিবর্তনকে নিরপেক্ষভাবে দেখলে মহান ধর্ম ইসলামের সৃষ্টিশীল প্রভাবকে অস্বীকার করার কোনও উপায় থাকে না। তাই তিনি বারবার বলতেন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারে সম্রাট আকবরের উদার প্রয়াস রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাক্রমের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভারতের ইতিহাসকে জানা। আর এইজন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল সেই সব পণ্ডিতদের যাঁরা শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে গোঁড়ামিতে আবদ্ধ নন। তাই বাঙালির চিরন্তন উৎসব দুর্গোৎসবকে অতীব গুরত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। যাহোক রবীন্দ্রনাথের দুর্গাপূজা ভাবনায় লেখা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
বহু চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দুর্গা এবং দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে নানান বিষয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠিপত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলিতে ধর্মের ব্যাপারে তার বক্তব্য পরিস্ফুটিত হয়েছে।
১৯৩৪ সালের ২৫ এপ্রিল শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছেন : “...আমি যে জন্মব্রাত্য, শিশুকাল থেকেই আমি শ্রেণীভ্রষ্ট, এমনকি ব্রাহ্মসমাজও আমাকে খুঁটিতে বাঁধতে পারেনি। এইজন্যেই দেশের লোকের কাছ থেকে আমি প্রশংসা পেয়েছি প্রীতি পাইনি। কিন্তু বাঁধনের শর্তে প্রীতি যদি না পেয়ে থাকি তবে তা নিয়ে খেদ করব না।...”
১৯৩১ সালের ২৬ জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে হেমন্তবালা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন : “...আমি যে গৃহে জন্মেছি সেখানকার ধর্মেই দীক্ষা পেয়েছিলুম। সে ধর্মও বিশুদ্ধ। কিন্তু আমার মন তারই মাপে নিজেকে ছেঁটে নিতে কোনোমতেই রাজি ছিল না। তবু আমি এ নিয়ে টানা হেঁচড়া না করে বেশ সহজভাবেই আপন প্রকৃতির পথে চলেছিলুম। সেই পথ ধরেই আজ আমি নিজের উপযোগী গন্তব্যস্থানে পৌঁছেছি। এটাকে অপরাধ বলে মাথা খুঁড়ে মরি নি।...” এর পরের দিনই অর্থাৎ ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই হেমন্তবালাদেবীকে আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...কিন্তু একটি কথা মনে রেখ, চতুষ্পদে আমার চলা; সম্প্রদায়ের দুর্গে রুদ্ধদ্বারের মধ্যে আমি বাঁচি নে। এই জন্যে যদিও আমিও নিজের মত গোপন করি নে, তবু কাউকে ডাকাডাকি করে কোনদিন বলিনে আমার মত গ্রহণ করো। তুমি নিজের পথে নিজের মতে চললে তোমার প্রতি আমার স্নেহ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হবে এমন শঙ্কা কোনোদিন কোরো না।...” এই হেমন্তবালা দেবীকেই ১৯৩২ সালের ৮ নভেম্বর তারিখের আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...তোমার মা আমাকে ভুল বুঝেছেন। অবশ্য ধর্মমত আমার আছে কিন্তু কোনো সম্প্রদায় আমার নেই। আমি নিজেকে ব্রাহ্ম বলে গণ্যই করিনে। ...কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের দীক্ষা দেওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। কেননা আমি নিজেই যূথভ্রষ্ট, আমি ধর্মসমাজের তকমাপরা ছাপ-মারাদের মধ্যে কেই নই, রাজার দত্ত উপাধি আমি ত্যাগ করেছি সম্প্রদায়ের দত্ত উপাধিও আমার নেই।...” আবার, এই হেমন্তবালাদেবীর কন্যা বাসন্তী দেবীকে ১৯৩৩ সালের ৫ নভেম্বর তারিখের একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে প্রায় একই মতামত জানিয়ে লিখেছেন : “শুনে আশ্চর্য হবে তোমার সঙ্গে আমাদের ধর্মের অমিল নেই। আমি দীক্ষা নিই নি, নেবও না, আমার ভগবান কোনো সম্প্রদায়ের ছাঁচে ঢালা ভগবান নন।...”
তবে ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কার সবচেয়ে মূল্যবান অভিমতটি ব্যক্ত করেছেন হেমন্তবালা দেবীকে লিখিত ১৯৩৪ সালের ১৭ আগস্ট তারিখের একটি চিঠিতে। শান্তিনিকেতন থেকে ঐ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...তোমাদের সমাজের দিক থেকে আমি ব্রাত্য, আমি এক ঘরে, আমি অস্পৃশ্য। এই বর্জন আমার জীবনে দেবতার বরের মত কাজ করছে, এতে মানুষের অভিশাপ যদি লাগে, তবে তাতে সাপের নিঃশ্বাস লাগবে মাত্র বিষ লাগবে না।...” এই ভাবটিই প্রকাশ পেয়েছে “পত্রপুট”-এর পনেরো সংখ্যক কবিতায় :
১৬০০ সালে যখন রোমে জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মরণ - খুঁটিতে বেঁধে, তখনই আগ্রায় সর্বপ্রথম সম্রাট আকবরের আহ্বানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের আয়োজন ঘটছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, পারসিক, ইহুদি এমনকি নাস্তিকদেরও।
রবীন্দ্রনাথের মানবধর্ম আবিষ্কার হঠাৎ করে হয়নি, এই আবির্ভাবের পিছনে কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতা, দর্শন ও সংস্কৃতির বিবর্তন রয়েছে। এমনকি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টিশীল আদান-প্রদানের ইতিহাসের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহ ছিল বেশ গভীর। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, সমসাময়িকতায় আচ্ছন্ন অনেক ভারতীয় ইসলামের এই প্রভাবকে মেনে না নিলেও, হিন্দু ধর্মের বিবর্তনকে নিরপেক্ষভাবে দেখলে মহান ধর্ম ইসলামের সৃষ্টিশীল প্রভাবকে অস্বীকার করার কোনও উপায় থাকে না। তাই তিনি বারবার বলতেন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারে সম্রাট আকবরের উদার প্রয়াস রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাক্রমের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ভারতের ইতিহাসকে জানা। আর এইজন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল সেই সব পণ্ডিতদের যাঁরা শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে গোঁড়ামিতে আবদ্ধ নন। তাই বাঙালির চিরন্তন উৎসব দুর্গোৎসবকে অতীব গুরত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। যাহোক রবীন্দ্রনাথের দুর্গাপূজা ভাবনায় লেখা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
বহু চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়েও রবীন্দ্রনাথ দুর্গা এবং দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে নানান বিষয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠিপত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলিতে ধর্মের ব্যাপারে তার বক্তব্য পরিস্ফুটিত হয়েছে।
১৯৩৪ সালের ২৫ এপ্রিল শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখেছেন : “...আমি যে জন্মব্রাত্য, শিশুকাল থেকেই আমি শ্রেণীভ্রষ্ট, এমনকি ব্রাহ্মসমাজও আমাকে খুঁটিতে বাঁধতে পারেনি। এইজন্যেই দেশের লোকের কাছ থেকে আমি প্রশংসা পেয়েছি প্রীতি পাইনি। কিন্তু বাঁধনের শর্তে প্রীতি যদি না পেয়ে থাকি তবে তা নিয়ে খেদ করব না।...”
১৯৩১ সালের ২৬ জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে হেমন্তবালা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন : “...আমি যে গৃহে জন্মেছি সেখানকার ধর্মেই দীক্ষা পেয়েছিলুম। সে ধর্মও বিশুদ্ধ। কিন্তু আমার মন তারই মাপে নিজেকে ছেঁটে নিতে কোনোমতেই রাজি ছিল না। তবু আমি এ নিয়ে টানা হেঁচড়া না করে বেশ সহজভাবেই আপন প্রকৃতির পথে চলেছিলুম। সেই পথ ধরেই আজ আমি নিজের উপযোগী গন্তব্যস্থানে পৌঁছেছি। এটাকে অপরাধ বলে মাথা খুঁড়ে মরি নি।...” এর পরের দিনই অর্থাৎ ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই হেমন্তবালাদেবীকে আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...কিন্তু একটি কথা মনে রেখ, চতুষ্পদে আমার চলা; সম্প্রদায়ের দুর্গে রুদ্ধদ্বারের মধ্যে আমি বাঁচি নে। এই জন্যে যদিও আমিও নিজের মত গোপন করি নে, তবু কাউকে ডাকাডাকি করে কোনদিন বলিনে আমার মত গ্রহণ করো। তুমি নিজের পথে নিজের মতে চললে তোমার প্রতি আমার স্নেহ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হবে এমন শঙ্কা কোনোদিন কোরো না।...” এই হেমন্তবালা দেবীকেই ১৯৩২ সালের ৮ নভেম্বর তারিখের আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...তোমার মা আমাকে ভুল বুঝেছেন। অবশ্য ধর্মমত আমার আছে কিন্তু কোনো সম্প্রদায় আমার নেই। আমি নিজেকে ব্রাহ্ম বলে গণ্যই করিনে। ...কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের দীক্ষা দেওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। কেননা আমি নিজেই যূথভ্রষ্ট, আমি ধর্মসমাজের তকমাপরা ছাপ-মারাদের মধ্যে কেই নই, রাজার দত্ত উপাধি আমি ত্যাগ করেছি সম্প্রদায়ের দত্ত উপাধিও আমার নেই।...” আবার, এই হেমন্তবালাদেবীর কন্যা বাসন্তী দেবীকে ১৯৩৩ সালের ৫ নভেম্বর তারিখের একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে প্রায় একই মতামত জানিয়ে লিখেছেন : “শুনে আশ্চর্য হবে তোমার সঙ্গে আমাদের ধর্মের অমিল নেই। আমি দীক্ষা নিই নি, নেবও না, আমার ভগবান কোনো সম্প্রদায়ের ছাঁচে ঢালা ভগবান নন।...”
তবে ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কার সবচেয়ে মূল্যবান অভিমতটি ব্যক্ত করেছেন হেমন্তবালা দেবীকে লিখিত ১৯৩৪ সালের ১৭ আগস্ট তারিখের একটি চিঠিতে। শান্তিনিকেতন থেকে ঐ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “...তোমাদের সমাজের দিক থেকে আমি ব্রাত্য, আমি এক ঘরে, আমি অস্পৃশ্য। এই বর্জন আমার জীবনে দেবতার বরের মত কাজ করছে, এতে মানুষের অভিশাপ যদি লাগে, তবে তাতে সাপের নিঃশ্বাস লাগবে মাত্র বিষ লাগবে না।...” এই ভাবটিই প্রকাশ পেয়েছে “পত্রপুট”-এর পনেরো সংখ্যক কবিতায় :
১৬০০ সালে যখন রোমে জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মরণ - খুঁটিতে বেঁধে, তখনই আগ্রায় সর্বপ্রথম সম্রাট আকবরের আহ্বানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের আয়োজন ঘটছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, পারসিক, ইহুদি এমনকি নাস্তিকদেরও।
হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ,
পরিত্রাণ কর, -
ভেদচিহ্নের তিলক-পরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
হে মহান পুুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তোমাকে
তামসের পরপার হতে
আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা।...
আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন
সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে
মানবলোকে,
আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষ
আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।
পরিত্রাণ কর, -
ভেদচিহ্নের তিলক-পরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
হে মহান পুুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তোমাকে
তামসের পরপার হতে
আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা।...
আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন
সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে
মানবলোকে,
আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষ
আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।
ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই ধারণা বহুদিন আগেই গড়ে উঠেছে। তাই প্রচলিত পূজার্চানাবিধির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রবীন্দ্রনাথ বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। আমাদের দেশের পূজার্চনাবিধি সম্পর্কে এবং এর মূল্যবোধ সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা থাকলেও দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিচার করে এই পূজার্চনাবিধিকে যাতে কোনো কিছু কলুষিত না করে সে সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। তাই পুলিনবিহারী সেনকে ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বর একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ। একটি ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছিলেন যে, “একদিন আমার পরেলোকগত বন্ধু হেমচন্দ্র বসু মল্লিক বিপিন পাল মহাশয়কে সঙ্গে করে একটি অনুরোধ নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁদের কথা ছিল এই যে, বিশেষভাবে দুর্গামূর্তির সঙ্গে মাতৃভূমির দেবীরূপ মিলিয়ে দিয়ে তাঁরা শারদীয়া পূজার অনুষ্ঠানকে নূতনভাবে দেশে প্রবর্তিত করতে চান, তার উপযুক্ত ভক্তি ও উদ্দীপনামিশ্রিত স্তবের গান রচনা করবার জন্য আমার প্রতি তাঁদের বিশেষ অনুরোধ। আমি অস্বীকার করে বলেছিলুম, এ-ভক্তি আমার আন্তরিক হতে পারে না; সুতরাং এতে আমার অপরাধের কারণ ঘটবে। বিষয়টা যদি কেবলমাত্র সাহিত্যের ক্ষেত্রের অধিকারগত হত তাহলে আমার ধর্মবিশ্বাস যাই হোক আমার পক্ষে তাতে সংকোচের কারণ থাকত না; কিন্তু ভক্তির ক্ষেত্রে পূজার ক্ষেত্রে অনধিকার প্রবেশ গর্হণীয়। আমার বন্ধুরা সন্তুষ্ট হননি। আমি রচনা করেছিলুম ভূবনমনোমোহিনী, এ গান পূজামণ্ডপের যোগ্য নয় সে কথা বলা বাহুল্য।”
৫.
পুজোর সময়ে নামী লেখকদের লেখা পাবার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদকেরা পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এ কথা ছিল। নানান সম্পাদকের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাদের পত্রপত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য অনুরোধ আসত। যত দূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পুজোর লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হল প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ “শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা। ‘পাবর্ণী’ প্রথম শারদীয় বার্ষিকী হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’র সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন : “তোমার ‘পার্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভালো লাগিবে। তোমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের ঝুলি হইতে বাংলাদেশের ছেলেদের জন্য এই যে পার্বণী আদায় করিয়াছ ইহা একদিকে যত বড়োই দুঃসাধ্য কাজ অন্যদিকে ততবড়ই পুণ্য কর্ম। বস্তুত ইহার বৈচিত্র্য। সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার ভাবিবার বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধুলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে ইহা আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্যব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে। প্রথম খণ্ড পার্বণীতে যে আদর্শে ডালি সাজাইয়াছ বৎসরে বৎসরে তাহা রক্ষা করিতে পারিলে মা ষষ্ঠী ও মা সরস্বতী উভয়েরই প্রসাদ লাভ করিবে। আজকাল কাগজ প্রভৃতির দুর্মূল্যতার দিনে কেমন করিয়া দেড় টাকা দামে তুমি এই বই বাহির করিলে বুঝিতে পারিলাম না। বোধ করি সংগ্রহ করিবার উৎসাহে লাভ লোকসান খতাইয়া দেখিবার সময়ও পাও নাই। ইতি ৯ই আশ্বিন, ১৩২৫।”
১৯৩৫ সালে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পুজো সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘একশো টাকা বায়না’ দেওয়া হয়। ঘটনাটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালের ২৯ আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন “এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় দেশ ও আনন্দবাজারের দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্যে একশো টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেইজন্যে ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।...” শারদীয় সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা পাবার জন্য সম্পাদকের চেষ্টার অন্ত থাকত না। যে সম্পাদক তাঁর কাছ থেকে পুজোর লেখা আদায় করতে সক্ষম হতেন না তিনিও রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করতেন। এ ব্যাপারে কখনও কখনও উড়ো খবরও প্রচারিত হতো। যেমন, ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কাছে খবর এল যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি সে বছর পুজোতে সঞ্চয় ভট্টাচার্যের পত্রিকায় লেখা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে বুদ্ধদেব বসুকে শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট একটি চিঠিতে লিখলেন “নিজের কাজের ভিড় জমে উঠেছে তাছাড়া শরীর ক্লান্ত। লিখে ওঠা সম্ভব হবে না।
খোঁচার ঘায়ে খেজুরের গাছের অসম্মান করলে সে রস দেয়, বোধহয় এই গুজবটা রটে গেছে তাই সঞ্জীব ভট্টাচার্য তাঁর পুজোর সংখ্যক কাগজের জন্য আমার একখানা লেখা দাবি করেছেন আমি বিস্মিত।” চিঠিতে উল্লেখিত সঞ্জীব ভট্টাচার্য সম্ভবত সঞ্জয় ভট্টাচার্যই হবেন।
পুজোর সময়ে নামী লেখকদের লেখা পাবার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদকেরা পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এ কথা ছিল। নানান সম্পাদকের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাদের পত্রপত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য অনুরোধ আসত। যত দূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পুজোর লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হল প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ “শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা। ‘পাবর্ণী’ প্রথম শারদীয় বার্ষিকী হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’র সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন : “তোমার ‘পার্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভালো লাগিবে। তোমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের ঝুলি হইতে বাংলাদেশের ছেলেদের জন্য এই যে পার্বণী আদায় করিয়াছ ইহা একদিকে যত বড়োই দুঃসাধ্য কাজ অন্যদিকে ততবড়ই পুণ্য কর্ম। বস্তুত ইহার বৈচিত্র্য। সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার ভাবিবার বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধুলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে ইহা আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্যব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে। প্রথম খণ্ড পার্বণীতে যে আদর্শে ডালি সাজাইয়াছ বৎসরে বৎসরে তাহা রক্ষা করিতে পারিলে মা ষষ্ঠী ও মা সরস্বতী উভয়েরই প্রসাদ লাভ করিবে। আজকাল কাগজ প্রভৃতির দুর্মূল্যতার দিনে কেমন করিয়া দেড় টাকা দামে তুমি এই বই বাহির করিলে বুঝিতে পারিলাম না। বোধ করি সংগ্রহ করিবার উৎসাহে লাভ লোকসান খতাইয়া দেখিবার সময়ও পাও নাই। ইতি ৯ই আশ্বিন, ১৩২৫।”
১৯৩৫ সালে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পুজো সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘একশো টাকা বায়না’ দেওয়া হয়। ঘটনাটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালের ২৯ আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন “এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় দেশ ও আনন্দবাজারের দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্যে একশো টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেইজন্যে ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।...” শারদীয় সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা পাবার জন্য সম্পাদকের চেষ্টার অন্ত থাকত না। যে সম্পাদক তাঁর কাছ থেকে পুজোর লেখা আদায় করতে সক্ষম হতেন না তিনিও রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করতেন। এ ব্যাপারে কখনও কখনও উড়ো খবরও প্রচারিত হতো। যেমন, ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কাছে খবর এল যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি সে বছর পুজোতে সঞ্চয় ভট্টাচার্যের পত্রিকায় লেখা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে বুদ্ধদেব বসুকে শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট একটি চিঠিতে লিখলেন “নিজের কাজের ভিড় জমে উঠেছে তাছাড়া শরীর ক্লান্ত। লিখে ওঠা সম্ভব হবে না।
খোঁচার ঘায়ে খেজুরের গাছের অসম্মান করলে সে রস দেয়, বোধহয় এই গুজবটা রটে গেছে তাই সঞ্জীব ভট্টাচার্য তাঁর পুজোর সংখ্যক কাগজের জন্য আমার একখানা লেখা দাবি করেছেন আমি বিস্মিত।” চিঠিতে উল্লেখিত সঞ্জীব ভট্টাচার্য সম্ভবত সঞ্জয় ভট্টাচার্যই হবেন।
৬.
বিজয়া দশমী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা চিন্তা ও আগ্রহ কম ছিল না। সমস্ত রকমের ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং কুসংস্কারের বেড়াজালকে ভেদ করে রবীন্দ্রনাথ বিজয়ার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন। বিজয়ার কোলাকুলির মতো আনন্দ-উৎসব থেকে সরিয়ে রাখাকেও তাই রবীন্দ্রনাথ মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। এর কারণ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ নিজের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন : “শ্রীমান নগেন্দ্রনাথ, আমি ব্রাহ্ম এবং আমাদের পরিবার ব্রাহ্মধর্মে প্রথম দীক্ষিত। অতএব আমি যে ব্রাহ্মসমাজের বিরোধী কোনো উপদেশ দিব এমন সন্দেহ মনে স্থান দিয়ো না। বস্তুত উপদেশ দিতেই আমার প্রবৃত্তি নাই। যে সংস্কারের মধ্যে বাল্যকাল হইতে মানুষ হইয়াছে সে সংস্কার যে আমার কথাতেই দূর হইবে এরূপ আশা করাও অসঙ্গত। তুমি ধর্ম শোধনের পক্ষপাতী, হিন্দু সমাজের সমস্ত ভাল জিনিসকেও তাহার ধর্ম হইতে ছিন্ন করিয়া ব্রাহ্ম সমাজের কাঠামোর মধ্যে পুরিয়া তবে তোমার মন তৃপ্ত হয়, অথচ ইহাও দেখিয়াছি যে সমস্ত ব্যাপারে খৃষ্টানী ধর্মের সঙ্গে জড়িত তাহার প্রতি তোমার কোনো আশঙ্কা নাই অথচ খৃষ্টান ধর্মও ত্রিত্ববাদ, অবতারবাদের আকার এবং খৃষ্টধর্মের ঈশ্বর মানবগুণে আক্রান্ত। আমি কিন্তু বিজয়ার দিনেই দেশের সকল লোভের সঙ্গে কোলাকুলি করিতে সঙ্কুচিত হওয়াকে সঙ্কীর্ণতা মনে করি এই দিনের শুভদিনত্ব বহুদিন ও বহুজনের অন্তর হইতে জাগ্রত হইয়াছে। ইহা আমার বা কয়েকজনের পরামর্শ করা নূতন সৃষ্টি নহে এই দেশব্যাপাী সদ্ভাবের বন্যাকে যে ব্যক্তি প্রত্যাখ্যান করিতে পারে সে আর যাই করুক ধর্মের দোহাই যেন না দেয় যে ধর্ম্মের শিক্ষায় এই সমগ্র দেশের আলিঙ্গনকে উপেক্ষা করিতে উৎসাহিত করে তাহার মধ্যে এমন নিশ্চয় কিছু আছে যাহা ধর্ম্মে নহে যাহা দলীয় দম্ভ। পৌত্তলিককে সর্ব্বপ্রযতে বার করিবার চেষ্টা নিজের মধ্যে দৃঢ় থাক কিন্তু সেই দৃঢ়তা দুর্গপ্রাচীরের মতো তোমাকে অন্যের সঙ্গে এবং দেশের সঙ্গে মিশিতে যেন বাধা না দেয়। তাঁহারা ধর্ম শোধনের পক্ষপাতী কোনোপ্রকার ধর্মের দ্বারা কাহারো নিকটে আসিতে চায় না। হিন্দু সমাজের প্রতি তোমার মনের ভাবটাও সেইরূপ হিন্দুসমাজকে প্রশ্রয় দিলেই পৌত্তলিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। অতএব বিজয়ার দিনে কোলাকুলি করাটাতে যোগ দিতে চাও না এবং হোলির দিনে যদি কেহ তোমার হায়ে আবির দেয় তবে তোমার চক্ষু আবিরের চেয়ে রক্তবর্ণ হইয়া উঠে। ঈশ্বর করুন তাঁহার ধর্মের নাম করিয়া আমি যেন কোনো ধর্মের কোনো সম্প্রদায়ের সদ্ভাব বা আনন্দের উৎসব হইতে নিজেকে অনধিকারী করিয়া না রাখি। যদি তাহাদের কোনো অনুষ্ঠানে কোনো মূঢ়তা থাকে আমি যেন নিজের জ্ঞানবিশুদ্ধ চিত্তভাবের দ্বারাই সহজেই তাহার শোধন করিতে থাকি কোনো মতের উপদ্রবে আমার মনে যেন প্রেমের অভাব না ঘটে। আমি যখন শাক্ত সম্প্রদায়ের প্রতি আমার একটা অন্ধ বিরাগ না হয়, আমি যখন চৈতন্যকে ভক্তি করিতে পারি তখন যে বৈষ্ণবকে সর্বদাই দূরে রাখিতে চেষ্টা না করি। ব্রাহ্মধর্ম যেন কোনো ধর্মকে বিদ্বেষপরায়ণ সংস্কারের দ্বারা দূরে ঠেকাইয়া না রাখে, যেমন সমুদ্র নদীকে নিজের মধ্যে অসঙ্কোচ আকর্ষণ করিয়া তাহাকে মুক্তি দান করে তেমনি করিয়া সমস্ত ধর্মকেই প্রেমের সহিত নিজের মধ্যে গ্রহণ করিবার জন্য যেন আহ্বান করে। উপনিষদে বলেন যিনি ঈশ্বরকে অন্তরে গ্রহণ করেন তিনি ‘সর্ব্বমাবিবেশ’ তিনি সকলেই মধ্যে প্রবেশ করেন তাঁহার হৃদয় কাহাকেও বাধা দেয় না। ব্রাহ্মধর্মও সেই উপনিষদের ব্রহ্মের জ্ঞান সেই ব্রহ্ম সঙ্কীর্ণ দেবতা নহেন এই জন্য সকল ধর্মই ব্রাহ্মধর্মকে আশ্রয় করিয়া বৃহৎ হইতে পারে ব্রাহ্মধর্ম কোনো ধর্ম্মের নিকট সঙ্কুচিত হয় না। আমি তোমাকে নিজের মতে আনিবার জন্য তর্ক করিতেছি না ব্রাহ্মধর্ম বলিতে আমি কি বুঝি তাহার কিঞ্চিতমাত্র আভাস দিতে চেষ্টা করিলাম। এ কথা লইয়া অধিক বাদ প্রতিবাদ করিবার প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর যদি তোমার চিত্তকে নিজের ঔদার্যে ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ করিয়া তোমার সমস্ত সঙ্কোচকে দূর করিয়া দেন তোমাকে সহজে সকলের সঙ্গে আনন্দে ও সদ্ভাবে মিশিবার উপযুক্ত বিশাল প্রেমের অধিকারী করেন তবেই তুমি রিফর্মরের ঔদ্ধত্য ত্যাগ করিয়া ধার্মিকের নম্রতা লাভ করিতে পারিবে।...”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দুর্গাপুজো সামাজিক মিলনের একটি উদার ক্ষেত্রস্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। এখানে মলিনতা নেই, হীনতা নেই, নেই কোন ছোট-বড়র হিসেব কিংবা আভিজাত্যের বড়াই। এখানে সবাই সব ভুলে মিলবে, মেলাবে, ‘যাবে না ফিরে’। এখানে সবার আমন্ত্রণ রয়েছে।
বিজয়া দশমী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা চিন্তা ও আগ্রহ কম ছিল না। সমস্ত রকমের ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং কুসংস্কারের বেড়াজালকে ভেদ করে রবীন্দ্রনাথ বিজয়ার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন। বিজয়ার কোলাকুলির মতো আনন্দ-উৎসব থেকে সরিয়ে রাখাকেও তাই রবীন্দ্রনাথ মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। এর কারণ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ নিজের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন : “শ্রীমান নগেন্দ্রনাথ, আমি ব্রাহ্ম এবং আমাদের পরিবার ব্রাহ্মধর্মে প্রথম দীক্ষিত। অতএব আমি যে ব্রাহ্মসমাজের বিরোধী কোনো উপদেশ দিব এমন সন্দেহ মনে স্থান দিয়ো না। বস্তুত উপদেশ দিতেই আমার প্রবৃত্তি নাই। যে সংস্কারের মধ্যে বাল্যকাল হইতে মানুষ হইয়াছে সে সংস্কার যে আমার কথাতেই দূর হইবে এরূপ আশা করাও অসঙ্গত। তুমি ধর্ম শোধনের পক্ষপাতী, হিন্দু সমাজের সমস্ত ভাল জিনিসকেও তাহার ধর্ম হইতে ছিন্ন করিয়া ব্রাহ্ম সমাজের কাঠামোর মধ্যে পুরিয়া তবে তোমার মন তৃপ্ত হয়, অথচ ইহাও দেখিয়াছি যে সমস্ত ব্যাপারে খৃষ্টানী ধর্মের সঙ্গে জড়িত তাহার প্রতি তোমার কোনো আশঙ্কা নাই অথচ খৃষ্টান ধর্মও ত্রিত্ববাদ, অবতারবাদের আকার এবং খৃষ্টধর্মের ঈশ্বর মানবগুণে আক্রান্ত। আমি কিন্তু বিজয়ার দিনেই দেশের সকল লোভের সঙ্গে কোলাকুলি করিতে সঙ্কুচিত হওয়াকে সঙ্কীর্ণতা মনে করি এই দিনের শুভদিনত্ব বহুদিন ও বহুজনের অন্তর হইতে জাগ্রত হইয়াছে। ইহা আমার বা কয়েকজনের পরামর্শ করা নূতন সৃষ্টি নহে এই দেশব্যাপাী সদ্ভাবের বন্যাকে যে ব্যক্তি প্রত্যাখ্যান করিতে পারে সে আর যাই করুক ধর্মের দোহাই যেন না দেয় যে ধর্ম্মের শিক্ষায় এই সমগ্র দেশের আলিঙ্গনকে উপেক্ষা করিতে উৎসাহিত করে তাহার মধ্যে এমন নিশ্চয় কিছু আছে যাহা ধর্ম্মে নহে যাহা দলীয় দম্ভ। পৌত্তলিককে সর্ব্বপ্রযতে বার করিবার চেষ্টা নিজের মধ্যে দৃঢ় থাক কিন্তু সেই দৃঢ়তা দুর্গপ্রাচীরের মতো তোমাকে অন্যের সঙ্গে এবং দেশের সঙ্গে মিশিতে যেন বাধা না দেয়। তাঁহারা ধর্ম শোধনের পক্ষপাতী কোনোপ্রকার ধর্মের দ্বারা কাহারো নিকটে আসিতে চায় না। হিন্দু সমাজের প্রতি তোমার মনের ভাবটাও সেইরূপ হিন্দুসমাজকে প্রশ্রয় দিলেই পৌত্তলিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। অতএব বিজয়ার দিনে কোলাকুলি করাটাতে যোগ দিতে চাও না এবং হোলির দিনে যদি কেহ তোমার হায়ে আবির দেয় তবে তোমার চক্ষু আবিরের চেয়ে রক্তবর্ণ হইয়া উঠে। ঈশ্বর করুন তাঁহার ধর্মের নাম করিয়া আমি যেন কোনো ধর্মের কোনো সম্প্রদায়ের সদ্ভাব বা আনন্দের উৎসব হইতে নিজেকে অনধিকারী করিয়া না রাখি। যদি তাহাদের কোনো অনুষ্ঠানে কোনো মূঢ়তা থাকে আমি যেন নিজের জ্ঞানবিশুদ্ধ চিত্তভাবের দ্বারাই সহজেই তাহার শোধন করিতে থাকি কোনো মতের উপদ্রবে আমার মনে যেন প্রেমের অভাব না ঘটে। আমি যখন শাক্ত সম্প্রদায়ের প্রতি আমার একটা অন্ধ বিরাগ না হয়, আমি যখন চৈতন্যকে ভক্তি করিতে পারি তখন যে বৈষ্ণবকে সর্বদাই দূরে রাখিতে চেষ্টা না করি। ব্রাহ্মধর্ম যেন কোনো ধর্মকে বিদ্বেষপরায়ণ সংস্কারের দ্বারা দূরে ঠেকাইয়া না রাখে, যেমন সমুদ্র নদীকে নিজের মধ্যে অসঙ্কোচ আকর্ষণ করিয়া তাহাকে মুক্তি দান করে তেমনি করিয়া সমস্ত ধর্মকেই প্রেমের সহিত নিজের মধ্যে গ্রহণ করিবার জন্য যেন আহ্বান করে। উপনিষদে বলেন যিনি ঈশ্বরকে অন্তরে গ্রহণ করেন তিনি ‘সর্ব্বমাবিবেশ’ তিনি সকলেই মধ্যে প্রবেশ করেন তাঁহার হৃদয় কাহাকেও বাধা দেয় না। ব্রাহ্মধর্মও সেই উপনিষদের ব্রহ্মের জ্ঞান সেই ব্রহ্ম সঙ্কীর্ণ দেবতা নহেন এই জন্য সকল ধর্মই ব্রাহ্মধর্মকে আশ্রয় করিয়া বৃহৎ হইতে পারে ব্রাহ্মধর্ম কোনো ধর্ম্মের নিকট সঙ্কুচিত হয় না। আমি তোমাকে নিজের মতে আনিবার জন্য তর্ক করিতেছি না ব্রাহ্মধর্ম বলিতে আমি কি বুঝি তাহার কিঞ্চিতমাত্র আভাস দিতে চেষ্টা করিলাম। এ কথা লইয়া অধিক বাদ প্রতিবাদ করিবার প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর যদি তোমার চিত্তকে নিজের ঔদার্যে ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ করিয়া তোমার সমস্ত সঙ্কোচকে দূর করিয়া দেন তোমাকে সহজে সকলের সঙ্গে আনন্দে ও সদ্ভাবে মিশিবার উপযুক্ত বিশাল প্রেমের অধিকারী করেন তবেই তুমি রিফর্মরের ঔদ্ধত্য ত্যাগ করিয়া ধার্মিকের নম্রতা লাভ করিতে পারিবে।...”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দুর্গাপুজো সামাজিক মিলনের একটি উদার ক্ষেত্রস্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। এখানে মলিনতা নেই, হীনতা নেই, নেই কোন ছোট-বড়র হিসেব কিংবা আভিজাত্যের বড়াই। এখানে সবাই সব ভুলে মিলবে, মেলাবে, ‘যাবে না ফিরে’। এখানে সবার আমন্ত্রণ রয়েছে।
১. ‘ধর্ম’ গ্রন্থের অন্তর্গত “উৎসব” প্রবন্ধটিতে লিখেছিলেন- উৎসবের দিন “একলার গৃহ সকলের গৃহ হয়, একলার ধন সকলের জন্য ব্যয়িত হয়। সেদিন ধনী দরিদ্রকে সম্মান করে, সেদিন পণ্ডিত মূর্খকে আসন দান করে। কারণ আত্মপর ধনী দরিদ্র পণ্ডিতমুর্খ এই জগতে একই প্রেমের দ্বারা বিধৃত হইয়া আছে। ইহাই পরম সত্য - এই সত্যের প্রকৃত উপলব্ধি পরমানন্দ। উৎসব দিনের অবধারিত মিলন এই উপলব্ধিরই অবসর। যে ব্যক্তি এই উপলব্ধি হইতে একেবারেই বঞ্চিত হইল, সে ব্যক্তি উন্মুক্ত উৎসব সম্পদের মাঝখানে আসিয়াও দীনভাবে রিক্তহস্তে ফিরিয়া চলিয়া গেল।”
২. ব্রাত্য হিসেবে ‘আবদ্ধ’ নি:সঙ্গতায় জীবন তো এই বংশটি যাপন করে আসছে শত শত বছর আগে থেকেই। নীলমণির ১৭৮৪ সালের নবযাত্রা থেকে ১৮৬১ সালে বিস্ময়কর রবীন্দ্রনাথের জন্ম পর্যন্ত ঠাকুর পরিবারের বিস্ময়কর উত্থান। নীলমণি ঠাকুরের তিন ছেলের মধ্যে বড় রামলোচন ও মেজ রামমণির বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণদিহির ‘আদি পিরালি’ বংশীয় রামকান্ত রায়চৌধুরীর দুই মেয়ে অলকা ও মেনকার সঙ্গে। রামলোচন-অলকা নিঃসন্তান ছিলেন। তাই মেনকা যখন পাঁচ বছরের রাধানাথ ও এক বছরের দ্বারকানাথকে রেখে মারা গেলেন, তখন জেঠামশায় রামলোচন ও জেঠাইমা (তথা মাসি) অলকা দত্তক নিয়ে নিলেন দ্বারকানাথকে।
৩. পলাশীর যুদ্ধের ১৭ বছর পরে, ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসন যখন একটু একটু করে কায়েম হতে আরম্ভ করেছে, সেই সময় ১৭৭৪ সালে রামমোহন রায়ের জন্ম হয়। ৩০ বছর বয়সে ১৮০৩-০৪ সালে রামমোহন লিখলেন তাঁর প্রথম বই ‘তুফাৎ উল মুয়োহাদিন’। বইটি রচিত ফার্সিতে, ভূমিকা আরবিতে। ১৮৮৪ সালে মৌলবী ওবেদুল্লা যখন বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ডি-ইস্ট বলা হয় তাঁদের যারা জগতের আদি কারণরূপে ঈশ্বরের কোনো হস্তক্ষেপ স্বীকার করেন না। এরকম ডি-ইস্ট ছিলেন বিলেতে নিউটন বা হিউম, ফরাসি দেশে ভলতেয়ার বা রুশো। আমাদের দেশের ১৯ শতকের যে দু’জন বিখ্যাত মানুষ তাঁদের দর্শন চিন্তায় ডি-ইস্ট বলে গণ্য হতে পারেন তাদের একজন অক্ষয় কুমার দত্ত অন্যজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অনেকেই এদের দু’জনকে নাস্তিক বলে জানেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের খুবই খুব গুরুত্ব দিয়ে তাঁর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এঁদের বিরুদ্ধে দেবেন্দ্রনাথের অভিযোগ- এবং বেশ গুরত্বপূর্ণ অভিযোগ যে এঁরা দু’জনেই নাস্তিক।
৪. ‘গোরা’ উপন্যাসে পরেশবাবু, আনন্দময়ী ও গোরার জবানীর মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মূর্তিপূজা এবং ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলিয়েছেন যা তার ব্যক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গে এক হয়ে যায়। আমি এ ধরনের তিনটি উক্তি এখানে উল্লেখ করছি।
(ক) পরেশবাবু সুচরিতাকে বলছেন : “সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিতে দেয়- মানুষ ব্রাহ্ম কি হিন্দু এই সমাজ-গড়া কথাটাকেই বিশ্ব সত্যের চেয়ে বড়ো করে তুলে একটা পাক তৈরি করে - এতক্ষণ মিথ্যা তাতে ঘুরে মরছিলুম।”
(খ) আনন্দময়ী সুচরিতাকে বলছেন : “তোমাদের ব্রাহ্মসমাজও কি মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলতে দেবে না? ঈশ্বর ভিতরে যাদের এক করেছেন তোমাদের সমাজ বাহির থেকে তাদের তফাত করে রাখবে? মা, যে সমাজে ছোটো অমিলকে মানে না, বড়ো মিলে সবাইকে মিলিয়ে দেয়, সে সমাজ কি কোথাও নেই? ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষ কি কেবল এমনি ঝগড়া করেই চলবে? সমাজ জিনিসটা কি কেবল এইজন্যেই হয়েছে?”
(গ) গোরা সুচরিতাকে বলছে : “ধর্ম সম্বন্ধে আমার নিজের কোনো বিশেষ সাধনা নেই, কিন্তু সাকারপূজা এবং পৌত্তলিকতা যে একই, মূর্তিপূজাতেই যে ভক্তিতত্ত্বের একটি চরম পরিণতি নেই, একথা আমি নিতান্ত অভ্যস্ত বচনের তো চোখ বুজে আওড়াতে পারব না। শিল্পে সাহিত্যে, এমনকি বিজ্ঞান ইতিহাসেও মানুষের কল্পনাবৃত্তির স্থান আছে, একমাত্র ধর্মের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই একথা আমি স্বীকার করব না। ধর্মের মধ্যেই মানুষকে সকল বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। আমাদের দেশের মূর্তিপূজায় জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে কল্পনার সম্মিলন হবার যে চেষ্টা হয়েছে সেটাতে করেই আমাদের দেশের ধর্ম কি মানুষের অন্যদেশের চেয়ে সম্পূর্ণতা সত্য হয়ে ওঠে নি?”
৫. ১৯৩৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে বুদ্ধদেব বসুকে একটি চিঠিতে লেখেন “অর্থের প্রযোজনে গল্প লিখতে হয়েছে। অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো সহজ পথ জানিনে বিপদে পড়লে সরস্বতীকে পান্ডা করে লক্ষ্মীর দরজায় যেতে হয়। সে লেখাটা বিক্রি করেছি।” রবীন্দ্রনাথ এই চিঠিতে ‘অর্থের প্রয়োজনে’ যে গল্প লেখার কথা বলেছে সে গল্পটি হল ‘রবিবার’। গল্পটি আনন্দবাজার পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় (২ আশ্বিন, ১৩৪৬ ) প্রকাশিত হয়।
২. ব্রাত্য হিসেবে ‘আবদ্ধ’ নি:সঙ্গতায় জীবন তো এই বংশটি যাপন করে আসছে শত শত বছর আগে থেকেই। নীলমণির ১৭৮৪ সালের নবযাত্রা থেকে ১৮৬১ সালে বিস্ময়কর রবীন্দ্রনাথের জন্ম পর্যন্ত ঠাকুর পরিবারের বিস্ময়কর উত্থান। নীলমণি ঠাকুরের তিন ছেলের মধ্যে বড় রামলোচন ও মেজ রামমণির বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণদিহির ‘আদি পিরালি’ বংশীয় রামকান্ত রায়চৌধুরীর দুই মেয়ে অলকা ও মেনকার সঙ্গে। রামলোচন-অলকা নিঃসন্তান ছিলেন। তাই মেনকা যখন পাঁচ বছরের রাধানাথ ও এক বছরের দ্বারকানাথকে রেখে মারা গেলেন, তখন জেঠামশায় রামলোচন ও জেঠাইমা (তথা মাসি) অলকা দত্তক নিয়ে নিলেন দ্বারকানাথকে।
৩. পলাশীর যুদ্ধের ১৭ বছর পরে, ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসন যখন একটু একটু করে কায়েম হতে আরম্ভ করেছে, সেই সময় ১৭৭৪ সালে রামমোহন রায়ের জন্ম হয়। ৩০ বছর বয়সে ১৮০৩-০৪ সালে রামমোহন লিখলেন তাঁর প্রথম বই ‘তুফাৎ উল মুয়োহাদিন’। বইটি রচিত ফার্সিতে, ভূমিকা আরবিতে। ১৮৮৪ সালে মৌলবী ওবেদুল্লা যখন বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ডি-ইস্ট বলা হয় তাঁদের যারা জগতের আদি কারণরূপে ঈশ্বরের কোনো হস্তক্ষেপ স্বীকার করেন না। এরকম ডি-ইস্ট ছিলেন বিলেতে নিউটন বা হিউম, ফরাসি দেশে ভলতেয়ার বা রুশো। আমাদের দেশের ১৯ শতকের যে দু’জন বিখ্যাত মানুষ তাঁদের দর্শন চিন্তায় ডি-ইস্ট বলে গণ্য হতে পারেন তাদের একজন অক্ষয় কুমার দত্ত অন্যজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অনেকেই এদের দু’জনকে নাস্তিক বলে জানেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁদের খুবই খুব গুরুত্ব দিয়ে তাঁর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এঁদের বিরুদ্ধে দেবেন্দ্রনাথের অভিযোগ- এবং বেশ গুরত্বপূর্ণ অভিযোগ যে এঁরা দু’জনেই নাস্তিক।
৪. ‘গোরা’ উপন্যাসে পরেশবাবু, আনন্দময়ী ও গোরার জবানীর মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মূর্তিপূজা এবং ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলিয়েছেন যা তার ব্যক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গে এক হয়ে যায়। আমি এ ধরনের তিনটি উক্তি এখানে উল্লেখ করছি।
(ক) পরেশবাবু সুচরিতাকে বলছেন : “সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিতে দেয়- মানুষ ব্রাহ্ম কি হিন্দু এই সমাজ-গড়া কথাটাকেই বিশ্ব সত্যের চেয়ে বড়ো করে তুলে একটা পাক তৈরি করে - এতক্ষণ মিথ্যা তাতে ঘুরে মরছিলুম।”
(খ) আনন্দময়ী সুচরিতাকে বলছেন : “তোমাদের ব্রাহ্মসমাজও কি মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলতে দেবে না? ঈশ্বর ভিতরে যাদের এক করেছেন তোমাদের সমাজ বাহির থেকে তাদের তফাত করে রাখবে? মা, যে সমাজে ছোটো অমিলকে মানে না, বড়ো মিলে সবাইকে মিলিয়ে দেয়, সে সমাজ কি কোথাও নেই? ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষ কি কেবল এমনি ঝগড়া করেই চলবে? সমাজ জিনিসটা কি কেবল এইজন্যেই হয়েছে?”
(গ) গোরা সুচরিতাকে বলছে : “ধর্ম সম্বন্ধে আমার নিজের কোনো বিশেষ সাধনা নেই, কিন্তু সাকারপূজা এবং পৌত্তলিকতা যে একই, মূর্তিপূজাতেই যে ভক্তিতত্ত্বের একটি চরম পরিণতি নেই, একথা আমি নিতান্ত অভ্যস্ত বচনের তো চোখ বুজে আওড়াতে পারব না। শিল্পে সাহিত্যে, এমনকি বিজ্ঞান ইতিহাসেও মানুষের কল্পনাবৃত্তির স্থান আছে, একমাত্র ধর্মের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই একথা আমি স্বীকার করব না। ধর্মের মধ্যেই মানুষকে সকল বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। আমাদের দেশের মূর্তিপূজায় জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে কল্পনার সম্মিলন হবার যে চেষ্টা হয়েছে সেটাতে করেই আমাদের দেশের ধর্ম কি মানুষের অন্যদেশের চেয়ে সম্পূর্ণতা সত্য হয়ে ওঠে নি?”
৫. ১৯৩৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে বুদ্ধদেব বসুকে একটি চিঠিতে লেখেন “অর্থের প্রযোজনে গল্প লিখতে হয়েছে। অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো সহজ পথ জানিনে বিপদে পড়লে সরস্বতীকে পান্ডা করে লক্ষ্মীর দরজায় যেতে হয়। সে লেখাটা বিক্রি করেছি।” রবীন্দ্রনাথ এই চিঠিতে ‘অর্থের প্রয়োজনে’ যে গল্প লেখার কথা বলেছে সে গল্পটি হল ‘রবিবার’। গল্পটি আনন্দবাজার পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় (২ আশ্বিন, ১৩৪৬ ) প্রকাশিত হয়।